সম্প্রতি হাঙ্গেরি থেকে আন্তর্জাতিক কোচিং কোর্স করে এসেছেন মাহফুজা খাতুন
সম্প্রতি হাঙ্গেরি থেকে আন্তর্জাতিক কোচিং কোর্স করে এসেছেন মাহফুজা খাতুন

হাঙ্গেরির কোচিং কোর্সে যা শিখে এলেন সাঁতারু মাহফুজা

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনন্য এক রেকর্ড আছে মাহফুজা খাতুনের (শীলা)। প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি সাঁতারু হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) দুটি সোনা জিতেছেন। দুটিই ২০১৬ সালে গুয়াহাটিতে।

খেলা ছাড়ার পর দেশে দুটি সংক্ষিপ্ত কোচিং কোর্স করে জাতীয় দলের সহকারী কোচ হন মাহফুজা। জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এ বছর জুনে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার সাঁতারু হবে আমার চেয়ে সেরা। সেভাবেই আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। কোচ হিসেবেও দেশের সাঁতারকে কিছু দিতে চাই।’

আমাদের দেশে সাঁতারের যেসব প্রতিযোগিতা হয়, সেগুলো আরেকটু আধুনিক করতে পারলে ভালো। স্পনসর এনে আরও সংগঠিতভাবে করতে পারলে ভালো কিছু পাব আমরা। হাঙ্গেরিতে দেখেছি, ছোটদের নিয়ে তারা সাঁতারে অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। আমাদের আরও প্রতিভা অন্বেষণ করে সাঁতার উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
মাহফুজা খাতুন, সাঁতার কোচ

সেই লক্ষ্য পূরণের আশায় সম্প্রতি হাঙ্গেরি থেকে আন্তর্জাতিক কোচিং কোর্স করে এসেছেন মাহফুজা। দেশের বাইরে এটিই তাঁর প্রথম কোচিং কোর্স। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অধীনে পরিচালিত দুই মাসব্যাপী এই ‘ইন্টারন্যাশনাল কোচিং কোর্স’টি হয়ে হাঙ্গেরিয়ান ইউনিভার্সিটি অব স্পোর্টস সায়েন্সে।

বাংলাদেশ থেকে এর আগে কোর্সটি করেছেন বাস্কেটবল, ভলিবল, অ্যাথলেটিকসসহ অন্য খেলার কোচরা। সাঁতারে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে মাহফুজাই প্রথম গেলেন। ১ অক্টোবর শুরু হওয়া কোর্সটি শেষ করে এ মাসের শুরুতে দেশে ফিরেছেন।

আমি আর্টস নিয়ে পড়েছি। ভারত থেকে যে কোর্স করতে এসেছে, সে–ও আর্টসে পড়েছে। বাকিরা ক্রীড়াবিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করেছে। ফলে এই কোর্সে গিয়ে আমাকে অনেক পড়তে হয়েছে, কষ্ট করতে হয়েছে। এটাই ছিল আমার দুর্বল জায়গা।
মাহফুজা খাতুন
হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের পতাকা হাতে মাহফুজা খাতুন

মাহফুজাসহ এবার কোর্সটি করেছেন ১৬ দেশের ১৬ জন। এশিয়া থেকে বাংলাদেশ ছাড়া আর ছিল চীন, ভারত ও শ্রীলঙ্কার একজন করে। বাকিরা ইউরোপ, আফ্রিকার। খেলোয়াড় তৈরি করতে একজন কোচের যেসব প্রাথমিক জ্ঞান থাকা দরকার, সেটাই মূলত কোর্সে শেখানো হয়েছে। মাহফুজা কিছুটা ব্যাখ্যাও করেন প্রথম আলোকে, ‘কোর্সে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান বায়োলজি, স্পোর্টস নিউট্রিশন, মনস্তত্ত্ব...ইত্যাদি ১৩টি বিষয়ে ক্লাস হয়েছে। শিক্ষকেরা নিজ দেশের জাতীয় দল বা বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা অনেক কিছু শিখেছি।’

একজন কোচ হিসেবে কখন কী করতে হবে, তা এই কোর্স করে জানতে-বুঝতে পেরেছি। এমনকি সাঁতারু চোট পেলে কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়, সেটাও। একজন কোচের সব দিকেই জ্ঞান থাকতে হবে। তাহলে কোচ তাঁর অ্যাথলেটকে বুঝতে পারবেন। এই অংশটা আমার বেশ ভালো হয়েছে।
মাহফুজা খাতুন

মাহফুজা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ওপর পড়াশোনা করেছেন। কোর্স করতে গিয়ে তাঁর উপলব্ধি, ক্রীড়াবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা থাকলে সবকিছু আরও ভালো বুঝতে পারতেন, ‘আমি আর্টস নিয়ে পড়েছি। ভারত থেকে যে কোর্স করতে এসেছে, সে–ও আর্টসে পড়েছে। বাকিরা ক্রীড়াবিজ্ঞান নিয়েই পড়াশোনা করেছে। ফলে এই কোর্সে গিয়ে আমাকে অনেক পড়তে হয়েছে, কষ্ট করতে হয়েছে। এটাই ছিল আমার দুর্বল জায়গা।’

কোচিং কোর্স চলার সময়ই বুদাপেস্টে ২০-২২ অক্টোবর হয়েছে সাঁতারের বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপ দেখাতেও নিয়ে যাওয়া হয় মাহফুজাদের

কোচিং কোর্স চলার সময়ই বুদাপেস্টে ২০-২২ অক্টোবর হয়েছে সাঁতারের বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপ দেখাতেও নিয়ে যাওয়া হয় মাহফুজাদের। এই সুযোগে কাছে থেকে দেখেছেন বিশ্বের সেরা কয়েকজন সাঁতারুকে। বিশ্বকাপে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে পাঁচটি অলিম্পিক সোনাজয়ী ফ্রিস্টাইল সাঁতারু নাথান আদ্রিয়া, ব্রেস্ট স্ট্রোকে অলিম্পিক সোনাজয়ী ইংল্যান্ডের সাঁতারু অ্যাডাম পিটিসহ আরও কয়েকজন অলিম্পিয়ান। তাঁরা কীভাবে অনুশীলন করেন, খেলার প্রতি কতটা নিবেদিত থাকেন, মাহফুজাদের কাছে সেসব বলেছেন। তাঁদের কোচরাও নিজেদের অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন। কীভাবে একজন বিশ্বমানের সাঁতারু তৈরি হয়, সে নিয়ে কথা বলেছেন। পাশাপাশি সাঁতারে বড় আয়োজন কীভাবে করা হয়, সেটাও দেখানো হয়েছে মাহফুজাদের।

কোচিং কোর্সে পাওয়া অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন দেশে সাঁতারু তৈরি করার কাজে মন দেবেন মাহফুজা। দেশে এসে বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনকে দিয়েছেন নানা পরামর্শও। সাঁতারু তৈরির বিজ্ঞানভিত্তিক ধাপগুলো নিয়ে ধারণা দিয়েছেন ফেডারেশনকে।

নিজের অভিজ্ঞতার জানাতে গিয়ে মাহফুজা বললেন, ‘একজন কোচ হিসেবে কখন কী করতে হবে, তা এই কোর্স করে জানতে-বুঝতে পেরেছি। এমনকি সাঁতারু চোট পেলে কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়, সেটাও। একজন কোচের সব দিকেই জ্ঞান থাকতে হবে। তাহলে কোচ তাঁর অ্যাথলেটকে বুঝতে পারবেন। এই অংশটা আমার বেশ ভালো হয়েছে।’ কোর্সে পরীক্ষাও হয়েছে। তাতে ৫–এর মধ্যে ৪.৬২ পেয়েছেন মাহফুজা। ফল নিয়েও তিনি খুশি।

হাঙ্গেরিতে সাঁতারের কোচিং প্রশিক্ষণ করতে গিয়ে ফাঁকে ফাঁকে ঘোরাফেরাও করেছেন মাহফুজা খাতুন

সাঁতার উন্নয়নে হাঙ্গেরি কীভাবে চেষ্টা করছে, কীভাবে বিভিন্ন ক্লাব প্রতিযোগিতা করে তারা, সেটার ধারণা দেওয়া হয়েছে মাফুজাদের। হাঙ্গেরি ইউরোপের মধ্যে খুব বেশি উন্নত দেশ নয়। কিন্তু সেখানে সাঁতারু তৈরির প্রক্রিয়াটা বেশ শক্তিশালী। দেশটিতে কতগুলো ক্লাব আছে, ক্লাব প্রতিযোগিতা কীভাবে হয়, সংগঠকেরা সেসব নিয়ে কথা বলেছেন মাহফুজাদের সঙ্গে।

খেলা ছাড়ার পর দেশে দুটি সংক্ষিপ্ত কোচিং কোর্স করে জাতীয় দলের সহকারী কোচ হন মাহফুজা। জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এ বছর জুনে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার সাঁতারু হবে আমার চেয়ে সেরা। সেভাবেই আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। কোচ হিসেবেও দেশের সাঁতারকে কিছু দিতে চাই।’

কোচিং কোর্সে পাওয়া অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন দেশে সাঁতারু তৈরি করার কাজে মন দেবেন মাহফুজা। দেশে এসে বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনকে দিয়েছেন নানা পরামর্শও। সাঁতারু তৈরির বিজ্ঞানভিত্তিক ধাপগুলো নিয়ে ধারণা দিয়েছেন ফেডারেশনকে। তাঁর কথা, ‘আমাদের দেশে সাঁতারের যেসব প্রতিযোগিতা হয়, সেগুলো আরেকটু আধুনিক করতে পারলে ভালো। স্পনসর এনে আরও সংগঠিতভাবে করতে পারলে ভালো কিছু পাব আমরা। হাঙ্গেরিতে দেখেছি, ছোটদের নিয়ে তারা সাঁতারে অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। আমাদের আরও প্রতিভা অন্বেষণ করে সাঁতার উন্নয়নে কাজ করতে হবে।’

হাঙ্গেরির এই অভিজ্ঞতা মাহফুজার কোচিং ক্যারিয়ারে এবং দেশের সাঁতারে কতটা কাজে লাগে, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।