সাঁতার পুলে অ্যাকশনে লিঁও মারশাঁ
সাঁতার পুলে অ্যাকশনে লিঁও মারশাঁ

প্যারিস অলিম্পিক

জল চিরে সোনা ফলাচ্ছেন মারশাঁ

লিঁও মারশাঁ বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে। লাজুক চোখে দেখছেন লা ডিফেন্সে অ্যারেনার চারপাশটা। হাজারো সমর্থকের মুখে তখন ‘লা মার্শেইয়ে’—ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত। মারশাঁও ঠোঁট মেলাচ্ছিলেন। তবে চোখ দুটো আর লাজুক থাকল না। অবিশ্বাস ও আনন্দের মিশ্রণে মারশাঁর চোখেমুখে তখন এক অন্য রকম দীপ্তি। পরে বলেছেন, সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে তাঁর খুব অস্বস্তি হয়। ২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টের বিজয়মঞ্চ থেকে নেমে ছোট্ট এক চক্কর ভিক্টরি ল্যাপ দিয়ে মারশাঁ তাই কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলেন।

মারশাঁর আসলে কিছু করার ছিল না। ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সোনা জয়ের পর মারশাঁ তখন ফ্রান্সের ইতিহাসে প্রথম সাঁতারু হিসেবে এক গেমসেই ব্যক্তিগত ইভেন্টে একাধিক সোনার পদকজয়ী। এর আগে জিতেছেন ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলির সোনা। দুটিতেই গড়েছেন নতুন অলিম্পিক রেকর্ড।

প্যারিস অলিম্পিকের ‘পোস্টার বয়’—তাঁকে ঘিরে এ গুঞ্জনে যদি কারও অবিশ্বাস থেকে থাকে, তবে সেটা ভেঙেছেন মারশাঁ নিজেই। কিন্তু এসব অনুভূতি কিংবা মুহূর্ত উদ্‌যাপনের সময় ছিল না তাঁর। ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সোনার পদক জয়ের পর অংশ নিতে হতো ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকের ফাইনালে। সে জন্য হাতে সময় ছিল মাত্র ৫০ মিনিট। তাই বাটারফ্লাইয়ের বিজয়মঞ্চ থেকে নেমেই ভিক্টোরি ল্যাপের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ছুটতে হয়েছে। কোথায়? আরেকটি সোনার সন্ধানে!

পানির নিচে মারশাঁ। ছুটছেন তিরবেগে

মারশাঁ সেই সোনার সন্ধান পেয়েছেনও। ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে সেই সোনার পদকের সঙ্গে এসেছে নতুন অলিম্পিক রেকর্ডও। এ যে কী বিস্ময় এবং সেই বিস্ময়ের গভীরতা বোঝাতে কিছু বিষয় বলতেই হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার ব্যবধানে কিংবা একই দিনে জেতা দূর অস্ত, অলিম্পিকের বাটারফ্লাই এবং ব্রেস্টস্ট্রোক দুই ইভেন্টেই মারশাঁর আগে কেউ পদক জেতেনি। আর দুটি সাঁতারের ধরনও আলাদা। শরীরে ভিন্ন ভিন্ন অংশ কাজ করে। ইভেন্ট দুটিও যদি প্রাণপণ চেষ্টায় জিততে হয়, তাহলে তো কথাই নেই।

২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে যেমন রুপাজয়ী ক্রিস্তফ মিলাকের সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ছিল মাত্র ০.৫৪ সেকেন্ড। একই দূরত্বের ব্রেস্টস্ট্রোকে রুপজয়ী জ্যাক স্টাবলেটি-ক্রুকের সঙ্গেও ব্যবধান মাত্র ০.৯৪ সেকেন্ডের। এ দুটি ইভেন্টেই আবার তাঁর কাছে হেরেছেন দুই ডিফেন্ডিং অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন!

ব্রেস্টস্ট্রোকের পুল থেকে উঠে মারশাঁ তাই হাঁপাচ্ছিলেন। গ্যালারিতে উন্মত্ত ফরাসি সমর্থকদের কণ্ঠও ‘লিঁও! লিঁও!’ স্লোগানে হাঁপরের মতো ওঠানামা করছিল।

মারশাঁ যে ইতিহাস গড়েছেন চাইলে তা ১০ কিলোমিটার দূরের ল্যুভর মিউজিয়ামে টাঙিয়ে রাখতে পারেন। কদরে মোনালিসার চেয়ে পিছিয়ে থাকবে না! তিনটি ইভেন্টের তিনটিতেই সোনা, এর মধ্যে দুটি সোনা এক দিনে প্রায় দুই ঘণ্টার ব্যবধানে। এই অতিমানবসুলভ ক্ষমতার জন্য সবার আগে কী প্রয়োজন? আত্মবিশ্বাস। তারপর? মানুষের ক্ষমতা কতটা—তা জানতে নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া।

২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক জয়ের পর বিজয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে মারশাঁ

মারশাঁর সাঁতার শেষ করার আত্মবিশ্বাস ছিল। কিন্তু সোনা জিতবেন দুটিতেই, সেই বিশ্বাস ছিল না, ‘জানতাম এটা আমার দ্বারা সম্ভব। তবে সেটা শুধু রেস শেষ করা। জয়ের কথা ভাবিনি। জানতামই না এটা সম্ভব।’ মারশাঁর পরের কথাগুলো শুনলে নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা বোঝা যায়, ‘এ জন্যই সাঁতরেছি। নিজের জন্য বিস্ময় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে মারশাঁ ‘দ্য ফ্রেঞ্চ মাইকেল ফেল্‌প্‌স।’ শুধু তাঁর পারফরম্যান্সের জন্য এই তকমা নয়, অলিম্পিকের ‘জলদানব’ ফেল্‌প্‌সের কোচ বব বোম্যান যে মারশাঁরও কোচ। সবচেয়ে সফল এ অলিম্পিয়ানের ঝুলিতে আছে ২৮টি পদক। কিন্তু ফেল্‌প্‌স নিজেও কখনো সাঁতারে এক রাতের সেশনে ‘ডাবল’ জয়ের চেষ্টা করেননি। ‘ফ্রেঞ্চ ফেল্‌প্‌স’ অন্তত এই জায়গায় আসল ফেল্‌প্‌সের চেয়ে এগিয়ে!

অলিম্পিকের ইতিহাসে এক দিনে দুটি ব্যক্তিগত পদক জিততে পেরেছেন মাত্র চারজন সাঁতারু। সেখানে ফেল্‌প্‌স নেই কিন্তু মারশাঁ আছেন। আরও আছেন সেই মেয়েটি, যে প্রথম নারী সাঁতারু হিসেবে অলিম্পিকের এক আসরে চারটি সোনার পদক জিতেছিল। সব কটিই সে সময়ের বিশ্ব রেকর্ড। পরে জানা গিয়েছিল, তাঁর দলের চিকিৎসকেরা অ্যাথলেটদের না জানিয়ে গোপনে তাঁদের শরীরে অল্প অল্প করে স্টেরয়েড প্রবেশ করিয়েছেন। সে কারণে ১৯৭৬ মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে তৎকালীন পূর্ব জার্মানির সাঁতারু কর্নেলিয়া এনদেরের কীর্তিকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তবু যেটা না বললেই নয়; মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে তখন ১৭ বছর বয়সী কর্নেলিয়া ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল এবং ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সোনা জিতেছিলেন মাত্র ২৭ মিনিটের ব্যবধানে!

ভিক্টোরি ল্যাপ দেওয়ার সময় ভক্তদের সঙ্গে মারশাঁ

গত ৪৮ বছরের মধ্যে প্রথম সাঁতারু হিসেবে এক রাতে দুটি ব্যক্তিগত সোনা জিতে কর্নেলিয়ার সেই স্মৃতিই ফিরিয়ে আনলেন মারশাঁ। তবে ব্যতিক্রমটা হলো, মারশাঁ জিতেছেন অলিম্পিকের বাটারফ্লাই এবং ব্রেস্টস্ট্রোক—এ দুটি ‘ডাবল’ জেতাই সবচেয়ে কঠিন এবং সেটাও এক রাতে। অস্ট্রেলিয়ার ফ্রেডরিক লেন এবং হাঙ্গেরির আলফ্রেড হাইওসকেও ভুলে গেলে চলবে না।

এই প্যারিসেই ১২৪ বছর আগে অনুষ্ঠিত (১৯০০) অলিম্পিকে ২০০ মিটারের ফ্রিস্টাইল ও অবস্টাকলস ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন লেন। তাঁর এই কীর্তির চার বছর আগে (১৮৯৬) এথেন্সে অনুষ্ঠিত আধুনিক সংস্করণের প্রথম অলিম্পিকে সাঁতারে ‘ডাবল’ জিতেছিলেন হাইওস। ভূমধ্যসাগরে প্রচণ্ড ঠান্ডা (১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং ১২ ফুট উচ্চতার ঢেউয়ের মধ্যেই ১০০ মিটার ও ১২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল জিতেছিলেন হাঙ্গেরির এই প্রথম অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন।

২২ বছর বয়সী মারশাঁর জাতটা তাই আলাদা, যেটা ধরতে পেরেছেন ফেল্‌প্‌স। সাঁতারের এই ‘গোট’ মারশাঁ-মাহাত্ম্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ‘এটা সম্ভবত খেলার ইতিহাসেই আমার দেখা সেরা ডাবল জয়। এই ছেলেটা সাঁতরাতে পারে। সে দীর্ঘদিন থাকবে। অনেক আলোচনার জন্ম দেবে।’

দীর্ঘদিন থাকা মানে তো পাদপ্রদীপের আলোয় থাকা। আলোচনার জন্ম দেওয়া মানেও সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা, যেটা একসময় ছিলেন ফেল্‌প্‌স। কিন্তু মারশাঁর তো আবার এসবে অস্বস্তি, ‘আমি খুব লাজুক মানুষ।’

২০০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টের বিজয় মঞ্চে মারশাঁ

মনে আছে, ফেল্‌প্‌স নিজেও তাঁর অলিম্পিক ক্যারিয়ারের শুরুতে মারশাঁর মতোই লাজুক ছিলেন? পদক জিততে জিততে—২৮টি পদকের মধ্যে ২৩টি সোনা, একসময় তাঁর সয়ে গেছে। মারশাঁরও তা-ই হবে হয়তো। ফেল্‌প্‌স এ নিয়ে কিছু বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘দেখতে ভালো লাগে যে একজন তরুণ স্বপ্ন দেখছে।’

কিংবা উল্টোভাবেও ভাবা যায়। মারশাঁই আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন—ফেল্‌প্‌সের শূন্যতা পূরণের।