বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে পাড়ামাতানো, ইচ্ছেডানা মেলে নিজের মতো ঘুরে বেড়ানো—সবই বেশ ভালো লাগত মেয়েটির। আর ভালোবাসত সাঁতার কাটতে। পুল, পুকুর বা যেকোনো জলাশয় দেখলেই মন চাইত জলে নেমে পড়তে। তাসমানিয়ার ‘সাধারণ’ সেই তরুণী আরিয়ার্না টিটমাস ভালোবাসার সাঁতার কাটতে কাটতেই নাম লিখিয়ে নিলেন ইতিহাসে, হয়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি সাঁতারু!
‘আমি নিজের দিকে তাকাই এবং নিজেকে সাধারণ মনে করি’—নিজেকে নিয়ে ২৩ বছর বয়সী টিটমাস সব সময়ই বলেন এমন সোজাসাপটা কথা। কথাটা তিনি গতকালও বলেছেন প্যারিসের লা ডিফেনসে অ্যারেনার পুলে অসাধারণ এক কীর্তি গড়ার পর। যুক্তরাষ্ট্রের কেটি লেডিকি ও কানাডার সামার ম্যাকিন্টোসকে পেছনে ফেলে প্যারিস অলিম্পিক সাঁতারে মেয়েদের ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের সোনা জিতেছেন তাসমানিয়ার টিটমাস।
অলিম্পিকে একটা সোনার পদক জয়ই অনেক বড় ব্যাপার। সেখানে টিটমাস এই ইভেন্টে জিতলেন টানা দুটি অলিম্পিক সোনা। এবার সোনা জিতে তো নিজের নামটা ইতিহাসে সোনার হরফেই খোদাই করে নিয়েছেন তিনি। প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে প্রথম নারী হিসেবে ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে জিতেছেন টানা দুই অলিম্পিকে সোনা। সঙ্গে ডন ফ্রেজারের পর প্রথম অস্ট্রেলিয়ান নারী হিসেবে সাঁতারের যেকোনো ইভেন্টে টানা দুবার অলিম্পিক সোনা জয়ের কীর্তিও গড়েছেন টিটমাস। ফ্রেজার ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত টানা তিন অলিম্পিকে জিতেছিলেন ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের সোনা।
এমন অসাধারণ কীর্তি গড়ার পরও ম্যাকিন্টোস নিজেকে ‘সাধারণ’ ও ‘বোকাসোকা’ এক মেয়ে বলেই মনে করেন। অন্যদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁকে যেন সাধারণই মনে করে সবাই। সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে টিটমাস বলেছেন, ‘আমি আশা করছি, কেউ আমাকে ভিন্নভাবে দেখবেন না—আমি সেই বোকাসোকা তাসি (তাসমানিয়ান) মেয়েটিই আছি, যে কি না এখানে তার স্বপ্ন পূরণ করতে এসেছে।’
২০১৮ সালের কমনওয়েলথ গেমসে তিনটি সোনা জেতা টিটমাস তাঁর স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে প্যারিস অলিম্পিক শুরুর আগেই বলেছিলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই আমি বিশ্বাস করি যে এবারের গেমসটি আমার হতে পারে।’ প্যারিসে সাঁতারের শুরুর দিনটাও তা–ই বলছে—এবারের অলিম্পিক হতে পারে টিটমাসের। ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের রেকর্ডের মালিক গতকাল প্রথম ল্যাপেই বাকিদের চেয়ে তিনি এতটা এগিয়ে গিয়েছিলেন যে ধারাভাষ্যকারেরা যেন তখনই সোনার পদক তাঁর গলায় দেখতে পাচ্ছিলেন!
অথচ এই প্রতিভাবানের ক্যারিয়ারে যতিচিহ্ন বসে যেতে নিচ্ছিল গত বছর সেপ্টেম্বরের দিকে। শুধু সাঁতার বা অলিম্পিকই নয়, মরতে বসেছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটিও। নিতম্বের চোটের চিকিৎসা চলছিল তখন টিটমাসের। তার মধ্যেই একদিন বড় এক দুঃসংবাদ পেলেন—তাঁর ডান পাশের ডিম্বাশয়ে ধরা পড়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত এক সমস্যা।
সেই দুঃসংবাদ টিটমাসের আলোকিত জগতে নিয়ে আসে অন্ধকার। সেই সময়ের চরম অস্থিরতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাকে যারা চেনে এবং বোঝে, তারা সবাই জানে, মা হওয়ার জন্য আমি জগতের সবকিছু বিসর্জন দিতে পারি। এটা (মা হওয়া) আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। তাই আমি খুব ভয়ংকর সময় পার করছি।’ নিজের অসুস্থতা নিয়ে ইনস্টাগ্রামে এই পোস্ট দেওয়ার পর তাঁর অ্যাথলেট–জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করতে শুরু করেন—অস্ত্রোপচার কি সফল হবে? তিনি কি মা হতে পারবেন? তাঁর ক্যারিয়ারে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
অস্ত্রোপচারের আগের মুহূর্ত নিয়ে টিটমাস বলেছেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল যে এতে ঝুঁকি আছে। কারণ, টিউমারটি এতটাই বড় ছিল যে আমার ডিম্বাশয়ও ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারত। একজন অ্যাথলেট হিসেবে এটা কঠিন। একজন নারী হিসেবেও এটা কঠিন। আমি নিজের শরীর এবং এর সামর্থ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। ফিট আর স্বাস্থ্যবান থাকার মানেই এই নয় যে আপনি এটা (তাঁর অসুস্থতা) সামলাতে পারবেন।’
টিটমাস অবশ্য সবকিছুই সামলাতে পেরেছিলেন। সফল অস্ত্রোপচারের পর তিনি আবার পুলে ফিরেছেন, এটাও জানতে পারেন যে তাঁর মা হওয়া নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। এরপর বাকি ছিল অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক দলে জায়গা করে নেওয়া। সেটা করেছেন এ বছরের জুনে অস্ট্রেলিয়ার সুইমিং ট্রায়ালে ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে। এখন লক্ষ্য প্যারিস অলিম্পিকটাকে নিজের করে নিতে একটি একটি করে স্বপ্ন পূরণ করা। যার শুরুটা তিনি করেছেন গতকাল ৪০০ মিটারের সোনার পদক ধরে রেখে।