যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড বিভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও ‘পিন পোস্ট’ করে রেখেছে। ভিডিওটা পরশু রাতে প্যারিস অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে ছেলেদের ১৫০০ মিটার ইভেন্টের ফাইনালের। যার ক্যাপশন, ‘পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমরা শুধু এটাই দেখতে থাকব।’
৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের এই ভিডিও শুধু পরবর্তী ঘোষণা আসা পর্যন্ত কেন, আজীবন গর্বভরে দেখতে চাইবেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সবাই। অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসে ১৫০০ মিটারের রাজা যে এখন অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী কোল হকার! ১৫১ বছরের পুরোনো এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তাই গর্বের যেন শেষ নেই।
বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জশ কার, নাকি বর্তমান (সর্বশেষ টোকিও) অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ইয়াকব ইঙ্গেব্রিগটসেন, কে জিতবেন সোনা—এ প্রশ্ন নিয়েই পরশু রাতে শুরু হয়েছিল ছেলেদের ১৫০০ মিটার দৌড়।
কিন্তু স্তাদ দে ফ্রান্সে দুজনের কেউ নন, সোনা জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কোল হকার। সেটিও নতুন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে। ৩ মিনিট ২৭.৬৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি ভেঙেছেন ইঙ্গেব্রিগটসেনেরই রেকর্ড। ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে নরওয়ের ইঙ্গেব্রিগটসেন ফিনিশ লাইন ছুঁতে ৩ মিনিট ২৮.৩২ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন। সেই ইঙ্গেব্রিগটসেন এবার কোনো পদক জিততে পারেননি; হয়েছেন চতুর্থ।
আরেক ফেবারিট কার ৩ মিনিট ২৭.৭৯ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে গ্রেট ব্রিটেনকে রুপা এনে দিয়েছেন। ব্রোঞ্জও গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে। ৩ মিনিট ২৭.৮০ সেকেন্ডে ফিনিশ লাইন ছুঁয়েছেন হকারেরই সতীর্থ ইয়ারেড নুগুসে।
অথচ হকারকে নিয়ে বাজি ধরার লোক খুব বেশি ছিল না। নিউইয়র্কভিত্তিক সাময়িকী ইউএস উইকলি বলছে, হকারকে এই দৌড় প্রতিযোগিতায় এতটাই ‘আন্ডারডগ’ মনে করা হয়েছিল যে তাঁর পক্ষে বাজির দর ছিল ১/৩০! ১২ জনের এই প্রতিযোগিতার ফাইনালে দৌড় শুরুর ৩০ সেকেন্ড পর হকার ছিলেন ৮ জনের পেছনে। দৌড় শেষ করার ২০ সেকেন্ড আগেও (১০০ মিটার বাকি থাকতে) ছিলেন তৃতীয় স্থানে। সেই তিনিই শেষ মুহূর্তে গতির ঝড় তুলে সবাইকে পেছনে ফেলেছেন। ২৩ বছর বয়সী এই দূরপাল্লার দৌড়বিদের রেকর্ড গড়ে সোনা জয়ের ঘটনাকে তাই প্যারিস অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় চমক বলা হচ্ছে।
অলিম্পিক মঞ্চে কোল হকারের এমন উত্থান নিয়ে বিবিসিতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করা সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্টিভ ক্র্যাম বলেছেন, ‘ওরা দুজন (ইঙ্গেব্রিগটসেন ও কার) একে অপরকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করেছিল। সেটি করতে গিয়ে কোল হকার বিস্ময়করভাব উঠে দাঁড়িয়েছে।’
স্টিভ ক্র্যাম যা-ই বলুন না কেন, হকারের উত্থান কিন্তু হুটহাট হয়নি। দূরপাল্লার দৌড়ে তাঁর নামডাক যুক্তরাষ্ট্রে আগে থেকেই আছে। আজ যে অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়ে খুশির বন্যা বইয়ে যাচ্ছে, সেই আনন্দ করতে পারত অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। হকারের প্রতিভা দেখে তাঁকে নিজেদের শিক্ষার্থী হিসেবে পেতে চেয়েছিল নর্দার্ন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজ অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু হকার ভর্তি হন অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় কলেজিয়েট অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশন (এনসিএএ) প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়টির হয়ে চারটি শিরোপা জেতেন। পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাইকি।
সর্বশেষ টোকিও অলিম্পিক দিয়ে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে’ অভিষেক হয় কোল হকারের। সেবার ১৫০০ মিটার ইভেন্টে হয়েছিলেন ষষ্ঠ। গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে হয়েছিলেন সপ্তম। তবে এ বছর বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিকস দিয়ে ঘুরে দাঁড়ান। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত সেই প্রতিযোগিতায় জেতেন রুপা। এবার তো প্যারিসে সাফল্যের শিখরেই পৌঁছে গেলেন। প্যারিসে পা রাখার আগেই হকার জানিয়েছিলেন, এমন কিছু করতে চান, যেন মানুষ তাঁকে মনে রাখেন।
পরশু রাতের ফাইনালে দৌড় শুরুর আগে ইঙ্গেব্রিগটসেন ও কার যখন সব আলো কেড়ে নিচ্ছিলেন, অনেকেই যখন মনে করছিলেন বাকিরা শুধু অংশগ্রহণের খাতিরে ট্র্যাকে নেমেছেন, তখন হকারের মনে জেদ চেপেছিল। অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে ১৫০০ মিটারের সোনা জিতে সে কথাই জানিয়েছেন এই দৌড়বিদ, ‘নিজেকে শুধু বলেছিলাম, এই দৌড়ে আমিও আছি।’
সত্যিই, হকারের কাছে এই দৌড় ছিল নিজের অস্তিত্বের জানান দেওয়ারও। অস্তিত্বের জানান এমনভাবে দিয়েছেন যে, এখন মানুষ তাঁর নাম বহুকাল মনে রাখতে বাধ্য।