জর্জিয়ান শুটার সালুকভাদজে
জর্জিয়ান শুটার সালুকভাদজে

প্যারিস অলিম্পিক

অলিম্পিকে বিস্ময়ের নাম জর্জিয়ার সালুকভাদজে

সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলেন নিনো সালুকভাদজে। টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার পরই জর্জিয়ান শুটারের মনে হয়েছিল, অনেক হয়েছে, এবার সময় এসেছে পিস্তলটাকে তুলে রাখার। সালুকভাদজের ‘অনেক’ আসলেই অনেক ছিল। এই নারী শুটার যখন প্রথম অলিম্পিকে অংশ নেন, পৃথিবীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের একটি দেশ ছিল। ১৯ বছর বয়সী সালুকভাদজে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কাস্তে–সংবলিত লাল পতাকা নিয়েই ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিকে খেলতে গিয়েছিলেন।

সেই অলিম্পিকে সালুকভাদজে ২৫ মিটার পিস্তলে সোনা ও ১০ মিটারে রুপা জেতার পর কত কিছু বদলে গেল পৃথিবীতে। কমিউনিজমের পতনে খণ্ডবিখণ্ড হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সালুকভাদজের মাতৃভূমি জর্জিয়া স্বাধীন হলো। করোনা নামের এক মহামারিতে পুরো পৃথিবী থমকে গেল। কিন্তু এত এত পরিবর্তনেও অপরিবর্তনীয় রইল একটা ব্যাপার—অলিম্পিক মানেই যে শুটিং রেঞ্জে সালুকভাদজের চিরন্তন উপস্থিতি। সিউলের পর বার্সেলোনা, আটালান্টা, সিডনি, এথেন্স, বেইজিং, লন্ডন, রিও ডি জেনিরো, টোকিও—টানা ৯টি অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার পরই সালুকভাদজে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে খুব বেশি দিন অটল থাকতে পারেননি সালুকভাদজে। তিনি পারেননি বাবার শেষ অনুরোধ ফেলতে। ‘প্যারিস অলিম্পিক তো মাত্র তিন বছরের দূরত্বে, তুমি কেন সেখানে কোয়ালিফাই করার সুযোগ নেবে না’—মেয়েকে এটাই বলেছিলেন ৯৩ বছর বয়সী বাবা। সালুকভাদজে বাবার অনুরোধ ফেলতে পারেননি। আর তাতেই তো ইতিহাস হলো। সেই সালুকভাদজে কাল শ্যাতোরুতে প্যারিস অলিম্পিকের শুটিং রেঞ্জে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে অংশ নিয়েই ইতিহাস হলেন।

ইতিহাসের অংশ হলেন সালুকভাদজে

কানাডার ইকুয়েস্ট্রিয়ান ইয়ান মিলারের সবচেয়ে বেশি—১০ বার অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার রেকর্ড ছুঁয়েছেন সালুকভাদজে। সালুকভাদজের মতো অবশ্য মিলার টানা ১০টি অলিম্পিকে অংশ নিতে পারেননি। ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকটা মিলারের কানাডা বর্জন না করলে হয়তো ১১ বার অলিম্পিকে খেলে রেকর্ডটা এখনো একান্তই নিজের কাছেই রাখতে পারতেন ১৯৭২ মিউনিখ থেকে ২০১২ লন্ডন পর্যন্ত ১০টি অলিম্পিকে ঘোড়া নিয়ে কসরত দেখানো মিলার।

সালুকভাদজে যে দশম অলিম্পিক খেলতে যাচ্ছেন, সেটি নিশ্চিত হয়েছিল গত বছরের ইউরোপিয়ান গেমসে। অলিম্পিক শুটিংয়ের বাছাইপর্ব হিসেবেই কাজ করেছিল সেটি।

সেই সালুকভাদজে এবারের অলিম্পিক শুরুর কয়েক দিন আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, পুরো ব্যাপারটাই কেমন জানি অবিশ্বাস্য মনে হয় তাঁর, ‘১০টি অলিম্পিক—আমার পুরো জীবন। প্রথম অলিম্পিকের পর এটা আমার ভাবনারও বাইরে ছিল যে আমি ১০টি অলিম্পিক খেলব। (লম্বা সময় টিকে থাকার ব্যাখ্যা নিয়ে) আমাকে হয়তো আস্ত একটা বই লিখতে হবে। তবে মনে হয় প্রতিটি জয়ের পর ভালো লাগার যে অনুভূতি হয়েছে, সেটিই আমাকে প্রতিদিন কঠোর অনুশীলন করতে বাধ্য করেছে।’

নিজেকে নিয়ে কোনো বই লিখলে নিশ্চিত সেটি বাবা ভাকতাংকে উৎসর্গ করবেন নিনো। শুটিংয়ের হাতেখড়িটা যে বাবার হাতেই হয়েছিল। রিও অলিম্পিকে নিনো সালুকভাদজের ছেলে সোতনে মাখাভারিয়ানিও অংশ নিয়েছিলেন। একই আসরে মা ও ছেলেকে খেলতে সেবারই প্রথম দেখেছে অলিম্পিক।

কীর্তির পর কীর্তি গড়া সালুকভাদজে জানালেন ২০২১ সালে অবসর নেওয়ার পর কী বলেছিলেন তাঁর বাবা, ‘টোকিওর পর সিদ্ধান্ত নিলাম অবসরের। কিন্তু আমার ৯৩ বছর বয়সী বাবা বললেন, “তিন বছর পরেই তো প্যারিস, কেন আরেকবার সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করবে না।” আমি ভাবলাম এটাই হয়তো বাবার শেষ অনুরোধ। এরপর সর্বশক্তি নিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আজ বাবা বেঁচে নেই, তাঁর অনুরোধ রাখতে পেরেই আমি সুখী।’

শুধু বাবার অনুরোধই নয়, ছেলের ‘হুমকি’ও শুনেছিলেন সালুকভাদজে, ‘আমার ছেলেও হুমকি দিয়েছিল “তুমি হাল ছেড়ে দিলে, আমি কিন্তু হাল ছেড়ে দেব…।”’

৩৬ বছরের অলিম্পিক ক্যারিয়ারে ১টি করে সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জজয়ী সালুকভাদজে কাল ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে ৩৮তম হয়ে বিদায় নিয়েছেন। তবে তাঁকে দেখার আরেকটি সুযোগ আছে, ২৫ মিটার পিস্তল ইভেন্টটা যে এখনো রয়ে গেছে!