সোনা জয় নিশ্চিতের পর রাই বেঞ্জামিনের মুখে হাসি
সোনা জয় নিশ্চিতের পর রাই বেঞ্জামিনের মুখে হাসি

ক্রিকেট পরিবার থেকে অলিম্পিকে সোনা জয় রাইয়ের

তাঁর জন্ম ক্রিকেটারের ঘরে। হতে চেয়েছিলেন রাগবির কোয়ার্টারব্যাক। কিন্তু হয়ে গেলেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অ্যাথলেট। শুধু কি তা–ই, অলিম্পিকে সোনাও জিতলেন!

বলা হচ্ছে রাই বেঞ্জামিনের কথা। ভদ্রলোককে না চিনলে তাঁর সর্বশেষ কীর্তিটা ধরিয়ে দেওয়া যায়। প্যারিসে গতকাল রাতে ছেলেদের ৪০০ মিটার হার্ডলস দৌড়ে সোনা জিতেছেন রাই। ফিনিশিং লাইনে পৌঁছানোর পর রাই হয়তো স্বস্তির নিশ্বাসও ফেলেছেন। শেষ পর্যন্ত একটি বৈশ্বিক সোনার পদকের দেখা পেলেন!

২০১৯ ও ২০২২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যক্তিগত এ ইভেন্টে জিতেছিলেন রুপা, ২০২৩ সালে এসে আরও খারাপ। বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। মাঝে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত টোকিও অলিম্পিকে অবশ্য রুপা জিতেছিলেন। কিন্তু প্যারিসে এসে রাই বুঝলেন, হাল ছাড়তে হয় না। নইলে সোনার পদকের দেখা মেলে না।

গতি রাইয়ের রক্তে। তাঁর বাবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ফাস্ট বোলার উইনস্টন বেঞ্জামিন। আশির দশকের মাঝ থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ২১ টেস্টে ৬১ উইকেট এবং ৯৫ ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট নিয়েছেন। তবে সে সময় ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের পেসারদের ধারা মেনে উইনস্টনের বড় পরিচয় হয়ে উঠেছিল আগ্রাসী মনোভাব ও গতি। তাঁর ছেলে রাই ছোটবেলায় ক্রিকেট যে একটু-আধটু খেলেননি, তা নয়। ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিলেন। ছোট ভাই হয়েছেন ফাস্ট বোলার। আর রাই হাইস্কুলে খেলেছেন রাগবির কোয়ার্টারব্যাক হিসেবে।

ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে আসতে তাঁকে রাজি করান হাইস্কুলের অ্যাথলেটিকস কোচ। ২০০১ সালের ১১ নভেম্বর নিউইয়র্ক থেকে অ্যান্টিগায় ফেরার পথে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তাঁদের বিমান পুয়ের্তো রিকোয় জরুরি অবতরণের পর সেখানে সপ্তাহখানেক থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন রাই। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়েননি। ২০১৯ দোহা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আগে নাগরিকত্ব পাল্টে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে যান রাই। তারপর ধরা দিল এই সোনালি সাফল্য।

এবার ওয়ারহোমকে পেছনে ফেলে সোনা জিতেছেন রাই

সেটাও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কারস্টেন ওয়ারহোমকে হারিয়ে। এর আগে তিনটি বড় প্রতিযোগিতায় ৪০০ মিটার হার্ডলসে নরওয়েজিয়ান দৌড়বিদের কাছে হেরেছিলেন রাই। ২০১৯ ও ২০২৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ওয়ারহোমের কাছে হারতে হয়েছিল। এর মাঝে টোকিও অলিম্পিকে অনেকের মতেই সর্বকালের অন্যতম সেরা সেই রেসেও রাই হেরেছিলেন ওয়ারহোমের কাছে।

কিন্তু এবার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হারের সেই মানসিক সমস্যা টপকে রাই-ই হেসেছেন শেষ হাসি। ৫৬.৪৬ সেকেন্ড টাইমিংয়ের সে হাসিকে আপনি সোনার হাসিও বলতে পারেন। ৪৭.০৬ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করা ওয়ারহোমের হাসি তাহলে রুপার। এমন সাফল্যের পর রাইয়ের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না! শুনুন তাঁর মুখেই, ‘বিশ্বাসই হচ্ছে না যে শেষ পর্যন্ত আমি এটা করতে পেরেছি। একদম সঠিক সময়েই হলো। আমার পরিবার এখানে, বন্ধুরাও আছে। তাদের সামনে এটা করতে পারা আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।’

রাইয়ের জন্ম নিউইয়র্কে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। নিজের এই সাফল্য তিনি উৎসর্গ করেছেন মা জিনেট ম্যাসনকে। অ্যান্টিগা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পর জিনেট ‘সিঙ্গেল মা’ হিসেবে তাঁকে বড় করে তুলেছেন। রাইয়ের ভাষায়, ‘পদে পদে মাকে পাশে পেয়েছি।’

মা কীভাবে যেন বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের মধ্যে বিশেষ কোনো প্রতিভা আছে। শঙ্কাও ছিল। গত জুলাইয়ে রকল্যান্ড/ওয়েস্টচেস্টার নিউজকে বলেছিলেন, ‘সন্তানের জীবন নিয়ে কথা বললে সেখানে স্বপ্ন ও প্রেরণা থাকতে হয়। সত্যি বলতে আমি ভেবেছি সে এডিএইচডিতে (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার)। প্রার্থনা করেছি এমন কিছু যেন খুঁজে পায়, যেখানে সে নিজের উদ্দীপনা কাজে লাগাতে পারে।’

ট্র্যাকে অ্যাকশনে রাই

সে উদ্দীপনা কাজে লাগানোর জায়গা যে ক্রিকেট নয়, তা মা–বাবা আগেই টের পেয়েছিলেন। যদিও ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার ব্যাটিং রাইয়ের চোখে ‘সম্মোহনী ব্যাপার।’ কিন্তু বাবা উইনস্টনের চোখে ক্রিকেট খেলায় রাই ‘একদমই যা–তা।’

শেষ পর্যন্ত ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে নেমে জীবন ভালোই কাটছে রাইয়ের। গ্যারেজে ল্যাম্বরগিনি আছে। আর আছে একটি সাইকেল, রাইয়ের চোখে যা বাইকের ‘ফেরারি।’ তবে পা দুটি সব সময় মাটিতেই থাকে রাইয়ের, ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু করছি না। কারও জীবনও বাঁচাচ্ছি না। মানুষের বিনোদনের জন্য দৌড়াই। এতে নিজের জীবনও ঝুঁকিতে ফেলছি না। এটা স্রেফ বিনোদন।’

দৌড়ের আগে রাই নিয়ম করে ‘ইন্টারস্টেলার’ সিনেমার সাউন্ডট্র্যাক শোনেন। তাতে নাকি দৌড়ে মনোযোগ থাকে। দৌড়ের মৌসুম শেষে অবশ্য রাই ফিরতে চান ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের বাড়িতে। আর সাইকেল নিয়ে চক্কর দিতে চান সেখানে। দুর্ঘটনার ভয় থাকলেও কোচের কাছ থেকে এটুকু অনুমতি পেয়েছেন।

রাইয়ের মুখে সোনার হাসি

ওহ, আরও একটি অভ্যাস তাঁর আছে। শুনুন রাইয়ের মুখেই, ‘লোকে যখন জানতে চায় ট্র্যাকের বাইরে কী করি, মানে বিনোদনের জন্য কী করি। আমি বলি তেমন কিছুই না, ঘরে ফিরে (কল অব ডিউটি ভিডিও গেমস) ওয়ারজোন খেলি।’

দীর্ঘ অপেক্ষায় পাওয়া সোনালি সাফল্যের পর রাইয়ের সামনে এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ। নিজের এই ইভেন্টে দাপটটা ধরে রাখতে হবে। রাই কি পারবেন? সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে তাঁর উত্তর আশাব্যঞ্জক, ‘সব সময় বলি উৎকর্ষকে তাড়া করো। নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করো—যদি ব্যর্থও হও, সাফল্য ধরা দেবে।’