এই মর্ত্যধামে খেলার সবচেয়ে বড় উৎসব—এ নিয়ে কোনো তর্ক নেই। শুধু খেলাতেই আটকে থাকা কেন, সবকিছু মিলিয়েই কি এমন আর কিছু দেখে এই পৃথিবী! বিশ্বের সব দেশের অংশগ্রহণে বিশ্বমানবের এমন মিলনমেলা? ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ কথাটা তো এমনি বলা হয় না। যা বললেই সবাই বুঝে ফেলেন, অলিম্পিক গেমসের কথা হচ্ছে। অথচ খেয়াল করে দেখুন, ‘খেলা’ বা খেলা বোঝায়, এমন কিছুই এখানে নেই।
‘গ্রেটেস্ট শো’ কেন? কিছু সংখ্যা থেকেই পেয়ে যাবেন এই প্রশ্নের উত্তর। আজ শুরু প্যারিস অলিম্পিকে উড়বে ২০৬টি দেশের পতাকা। ৩২টি খেলার ৩২৯টি ইভেন্টে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামবেন ১০ হাজার ৫০০ জন অ্যাথলেট। সাংবাদিকের সংখ্যা হয়তো ছাড়িয়ে যাবে এটিকেও। আর দর্শক তো থাকবে লাখ লাখ। সব মিলিয়ে অলিম্পিক সত্যিকার এক ক্রীড়া মহোৎসব। পদকের লড়াই ছাপিয়ে আসলে যা খেলার চিরন্তন চেতনার উদ্যাপন। বিশ্বভ্রাতৃত্বেরও। মানুষে মানুষে সংযোগ স্থাপনের এক মঞ্চও কি নয়! গ্রিসের প্রাচীন অলিম্পিককে আধুনিক যুগে ফিরিয়ে আনার স্বপ্নদ্রষ্টা পিয়েরে দ্য কুবার্তোর চিন্তাটা তো এমনই ছিল।
সেই পিয়েরে দ্য কুবেরতেঁর দেশেই এবারের অলিম্পিক। ঠিক ১০০ বছর পর যা আবারও ফিরছে প্যারিসে। ১৯০০ ও ১৯২৪ সালের পর এবার তৃতীয়বারের মতো। অলিম্পিক আয়োজনের এই ‘হ্যাটট্রিক’ ২০১২ সালেই করে রেখেছে লন্ডন। তিনবার অলিম্পিক আয়োজন করা নিয়ে প্যারিসের তাই গর্ব করার কিছু নেই।
তবে একটা জায়গায় শুধু লন্ডন নয়, অলিম্পিকের আগের সব আয়োজন থেকে শুরুতেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে প্যারিস। অলিম্পিক ইতিহাসে এই প্রথম উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হচ্ছে স্টেডিয়ামের বাইরে। ১৮৯৬ সালে এথেন্সে আধুনিক অলিম্পিকের শুরু থেকেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়ে আসছে অলিম্পিকের মূল স্টেডিয়ামে। যেখানে অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ অ্যাথলেটিকস হয়। প্যারিস অলিম্পিকে সেই স্টেডিয়াম স্তাদ দে ফ্রান্স। প্যারিসের উপকণ্ঠ সেন্ট ডেনিসে যে স্টেডিয়াম বানানো হয়েছিল ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে। যেখানে ব্রাজিলকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল ফ্রান্স।
অ্যাথলেটিকস এবার এখানেই হবে, আগামী ১১ আগস্ট সমাপনী অনুষ্ঠানও। আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান? সেটি হবে নদীতে! সিন নদীও তাই ঢুকে যাচ্ছে অলিম্পিক ইতিহাসে।
অলিম্পিককে স্বাগত জানাতে এরই মধ্যে বর্ণিল সাজে সেজেছে সিন নদীর দুই পাড়। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাচ-গান থাকে, থাকে আয়োজক দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলার হরেক আয়োজন। মাসের পর মাস সেসবের প্রস্তুতি চলে।
কোন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কত ভালো হলো, এ প্রতিযোগিতাও যে আছে। অন্য সব আয়োজনে ভিন্নতা থাকলেও একটা ব্যাপার কমন থাকে অলিম্পিকের সব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই। জাতীয় পতাকা নিয়ে অংশগ্রহণকারী সব কটি দেশের অ্যাথলেটদের মার্চপাস্ট। অলিম্পিকের জন্মভূমি গ্রিস থাকে সবার শুরুতে, সবার শেষে আয়োজক দেশ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি সময়জুড়ে থাকে এই মার্চপাস্ট।
নির্দিষ্ট সময়ে যা শেষ করা নিয়ে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা থাকে আয়োজকদের। এবার বোধ হয় তা আর থাকছে না। অ্যাথলেটরা তো আর পায়ে হেঁটে মার্চপাস্ট করছেন না। এবার মার্চপাস্ট হবে নৌযানে। মার্চপাস্টের অংশটা তো সবার জানাই থাকে, তবে চমক দিতে অন্য সব আয়োজন ঢাকা থাকে গোপনীয়তার চাদরে। এবারও তা-ই আছে। তারপরও টুকটাক কিছু খবর তো বেরিয়েই পড়ে। যেমন শোনা যাচ্ছে, নাচ-গানের আয়োজনে লেডি গাগাও থাকছেন।
প্যারিসের সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় (বাংলাদেশে রাত সাড়ে ১১টা) শুরু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি হবে ঘণ্টা চারেক। শেষাংশটা যেন সিন নদীতে সূর্যাস্তের অপরূপ ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই এই সময়সূচি। ফুটবল, রাগবি সেভেন, আর্চারি, হ্যান্ডবলের মতো কিছু খেলা শুরু হয়ে গেছে অলিম্পিকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই। অলিম্পিকে সব খেলারই কিছু না কিছু অনুসারী আছে, তবে দর্শক আগ্রহের বিচারে সবচেয়ে বড় দুই আকর্ষণ সাঁতার আর অ্যাথলেটিকস। একটি প্রায় শেষ হলে আরেকটি শুরুর প্রথাও এ কারণেই। শুরুর অর্ধেকে সাঁতার, শেষ অর্ধেকে অ্যাথলেটিকস।
এবারের অলিম্পিক আরেকটি কারণেও ব্যতিক্রমী। চার বছর বিরতির বদলে এবার তিন বছর পরই আরেকটি অলিম্পিক। সর্বশেষ অলিম্পিককে ‘টোকিও ২০২০’ বলা হলেও আসলে তা হয়েছে ২০২১ সালে। পুরো বিশ্বের মতো অলিম্পিকও যে আক্রান্ত হয়েছিল করোনাভাইরাসে। করোনাকালের নানা বিধিনিষেধ টোকিও অলিম্পিক থেকে কেড়ে নিয়েছিল উদ্যাপনের রং। প্যারিস ২০২৪ তাই অলিম্পিকের আবার অলিম্পিক হয়ে ওঠার উপলক্ষও।
যেখানে বাংলাদেশও আছে। আছে অলিম্পিক নিয়ে পিয়েরে দ্য কুবেরতেঁর অমর বাণী ‘জয়–পরাজয় নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা’র একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে। অলিম্পিকে পদক না জেতা সবচেয়ে জনবহুল দেশের যে রেকর্ডটি বাংলাদেশের অধিকারে, এবারও তা ভাঙার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ জন্য প্যারিসে যাওয়া বাংলাদেশের পাঁচ প্রতিযোগীকে দোষ দেবেন না যেন। অলিম্পিকে পদক জিততে যা করতে হয়, তা করলে না সেই অধিকার জন্মায়।