খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক ডিফেন্ডারকে ঘোল খাইয়ে গোল করেছেন। ক্লাব ও জাতীয় দলের জার্সিতে ছিলেন সফল স্ট্রাইকার। খেলা ছেড়ে ২০১৬ সাল থেকে বিকেএসপির হকি কোচ। সেই মওদুদুর রহমানের জীবন হঠাৎ থমকে গেছে। সকাল–বিকেল আর হকি মাঠে শিক্ষার্থীদের পাঠ দিতে দৌড়াচ্ছেন না। উল্টো ছুটতে হচ্ছে চিকিৎসকের কাছে। তাঁর শরীরে যে বাসা বেঁধেছে জটিল এক রোগ। বাংলাদেশের হকিতে শুভ নামে বেশি পরিচিত সাবেক এই খেলোয়াড়ের মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়েছে।
দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সাভার বিকেএসপির ক্যাম্পাসের বাসায় ভালোই কাটছিল তাঁর দিন। স্ত্রী বিকেএসপি পাবলিক স্কুলের শিক্ষিকা। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর সকালটা ৪৩ বছর বয়সী মওদুদুরের জন্য অশনিসংকেত হয়ে আসে। দেড় বছরের মেয়েকে খাইয়ে দিতে দিতে মেঝেতে লুটিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। স্ত্রী ও হকি কোচ মশিউর রহমানের (বিপ্লব) সহায়তায় দ্রুত তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিকেএসপির পাশেই বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত কেপিজে হাসপাতালে। ভর্তি করা হয় আইসিইউতে। এমআরআইয়ে তাঁর মাথায় টিউমারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে সেটা এখন প্রাথমিক স্তরেই আছে।
সেদিন কয়েক ঘণ্টা তাঁর জীবনে কী ঘটেছে, মনে করতে পারছেন না মওদুদুর। বিকেএসপি থেকে ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে কখন, কিছুই জানি না। সকালের কথা কিছুই মনে নেই। বিকেলের কথা একটু মনে পড়েছে হাসপাতালের আইসিইউতে যখন রানা, প্রিন্স, টিটুরা (বিকেএসপির হকি ব্যাচমেট) আসে। শুনেছি বিপ্লব সেদিন সারাক্ষণ পাশে ছিল, এখনো সে পাশেই আছে।’
মস্তিষ্কে টিউমার সরাতে হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। তবে মওদুদুরের অস্ত্রোপচার কখন করতে হবে, তা নিয়ে দুই রকম মত চিকিৎসকদের। একজন চিকিৎসক বলেছেন, শিগগিরই অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। আরেকজন বলেছেন, আরও কিছু পরীক্ষার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তবে যখনই হোক, অস্ত্রোপচারের বিকল্প নেই। পরিবার থেকে সবাই চাইছে বিদেশেই যেন অস্ত্রোপচার হয়। ভারতের বেঙ্গালুরুতে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেরা সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত দিতে চায়।
বিদেশে অস্ত্রোপচার করতে হলে দরকার অনেক টাকা। সারা জীবন হকির সঙ্গে যুক্ত থাকা মওদুদুরের সেই সামর্থ্য কতটাই–বা আছে! ক্রীড়াঙ্গন তাঁর পাশে দাঁড়ালে হয়তো অস্ত্রোপচারের কাজটা সহজ হয় এবং সুস্থ হয়ে আবার কোচিংয়ে ফিরতে পারেন। মওদুদুরও সেটাই চান। তাই রেখেছেন একটা আবেদন, ‘এই দুঃসময়ে সবাইকে পাশে চাই। ক্রীড়াঙ্গনে অবস্থাসম্পন্ন যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও যদি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়ান, তাহলে সাহস পাব।’
এরই মধ্যে বিকেএসপি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে বিশ্রামে থাকতে বলা হয়েছে। তবে মওদুদুরের মন থাকে মাঠেই, ‘জীবনে হকি ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। একদিন মাঠে না গেলে অস্থির লাগে। কিন্তু যাচ্ছি না এখন। আরও কিছু পরীক্ষা করতে হবে। আজ যেমন ঢাকায় যাচ্ছি কিছু পরীক্ষার জন্য। সবার দোয়া চাই, যেন আবার আগের মতো হকি নিয়ে কাজ করতে পারি।’
সাতক্ষীরার কলারোয়ার ছেলে মওদুদুর ১৯৯২ সালে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন বিকেএসপিতে। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক নামীদামি হকি খেলোয়াড়ের একজন তিনি। ১৯৯৬ সালে প্রথম ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলেন অ্যাজাক্সে। ২০০৪ সালে লিগ চ্যাম্পিয়ন ঊষা ক্রীড়াচক্রের অধিনায়ক। ১৫ গোল করে লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছেন সেবার। আবাহনীর হয়ে লিগ জিতেছেন ২০০৬ সালে। ঘরোয়া হকিতে আছে আরও কিছু সাফল্য।
১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সিতে খেলেছেন দুটি এশিয়ান গেমস, ২০০৩ এশিয়া কাপ হকি। ২০০১ সালে ঢাকায় প্রাইম মিনিস্টারস হকিতে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়। একই বছর স্কটল্যান্ডে খেলেন বিশ্বকাপ বাছাই। জাতীয় দলের জার্সিতে খেলেছেন ৪০টির বেশি ম্যাচ। ২০১৮ সালে জাতীয় দলের সহকারী কোচ ছিলেন। একই বছর লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের প্রধান কোচ। আরেকটি পরিচয়ও আছে তাঁর—ঢাবির ব্লু।