জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে আমি প্রথম খেলি ১৯৯৫ সালে। সবাই ভাবল, একটা বাচ্চা ছেলে প্রথমবার কোয়ালিফাই করল আর প্রথম রাউন্ডেই কিনা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খেলা! তত দিনে তিনি দুবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছেন। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাবও পেয়েছেন। তাঁর কাছে আমি তো হারব!
আমি কালো নিয়ে খেলছি। ওপেনিং তখন সেভাবে জানতাম না। জিয়া ভাই সেদিন d4 চালেন। কালো নিয়ে সেটার বিরুদ্ধে আমি কিংস ইন্ডিয়ান ডিফেন্স খেললাম। আমার প্রথম চাল ছিল nf6। মাঝপথে ম্যাচটা আমি জিতে যাই এবং প্রচারের আলোয় চলে আসি।
পরে জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে কিংস ইন্ডিয়ান ডিফেন্স ওপেনিংয়ে অনেক খেলেছি। কখনো তিনি জিতেছেন, কখনো আমি। একটা সময় আমি অন্য ওপেনিং শুরু করলাম। জিয়া ভাই আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, “তুমি সব ওপেনিং খেলো। কিংস ইন্ডিয়ান এখন আর খেলো না কেন?”’ আমি বললাম, কিংস ইন্ডিয়ান ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে আমি এখন সেটা খেলছি না।
এবারের ৪৮তম জাতীয় দাবার শেষ রাউন্ডের আগের দিন গত শুক্রবার ১২তম রাউন্ডে আমার আর জিয়া ভাই কারোরই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা ছিল না, গাণিতিক হিসাব যদিও ছিল। আমি ভাবলাম, এদিন কিংস ইন্ডিয়ানই খেলি। যেটা আমি অনেক বছর খেলিনি। ধরে নিয়েছিলাম, দুজনেরই জেতার সুযোগ থাকবে। অনেক দিন পর খেলছিলাম বলে কিংস ইন্ডিয়ান ডিফেন্সের সর্বশেষ খুঁটিনাটি সম্পর্কে সেভাবে অবগত ছিলাম না। এই ম্যাচে সাদা দিয়ে জিয়া ভাই প্রথম চাল দেন c4 । c4-এর বিরুদ্ধেও কিংস ইন্ডিয়ান ডিফেন্স খেলা যায়, আমি সে পথেই গেলাম। একটা সময় তিনি b4 দেন। আমি খুব অবাক হলাম। তাঁর পজিশন অনুযায়ী এই চালটা দেওয়ার কথা নয়।
বুঝতে পারছিলাম, এটা তো খুব ভালো একটা চাল। এর বিরুদ্ধে কীভাবে খেলব, চিন্তা করতে করতে দেখা গেল আমার সময় কমে যাচ্ছে। একটা পর্যায়ে আমি খুব বাজে একটা চাল দিয়ে বুঝতে পারলাম বোর্ডে আমার পজিশন খারাপ। আমার পুরো মনোযোগ তখন আত্মরক্ষা নিয়ে। যে কারণে তাঁর দিকে অত মনোযোগ দিতে পারিনি।
ম্যাচ তখন ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট হয়ে গেছে। ২৫তম চাল দিয়ে দিয়েছেন জিয়া ভাই। আমি তার জবাব খুঁজছিলাম। সাদা নিয়ে খেলা জিয়া ভাইয়ের অবস্থান ভালো ছিল।
হঠাৎ দেখি জিয়া ভাই চেয়ার থেকে একটু কাত হয়ে গেছেন। ভাবলাম, কোনো অসুবিধা হচ্ছে হয়তো। বা কোনো কিছু দেখছেন কি না মেঝেতে। প্রায় ১৫-২০ সেকেন্ড তিনি ওই অবস্থায় থাকার পর আমি তাঁর দিকে মনোযোগ দিই। এরপর আরেকটু কাত হয়ে যান। আমি জিজ্ঞেস করতে যাব, কোনো সমস্যা হলো কি না, ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি মেঝেতে পড়ে যান।
আমি লাফ দিয়ে উঠে তাঁকে ধরি, অন্যরা দৌড়ে আসে। কী হলো বোঝার চেষ্টা করছিল সবাই। ভাবি পাশের রুমে ছিলেন। একজন তাঁকে খবর দিলে তিনি দ্রুত চলে আসেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে, আমার সঙ্গে গাড়ি ছিল। খেলার আগে জমা দেওয়া মুঠোফোনটা নিয়ে ড্রাইভারকে কল করে বলি, ‘তুমি রেডি থাকো। আমরা নামতেছি।’
জিয়া ভাইকে দ্রুত শাহবাগে ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে নেওয়া হয়। জরুরি বিভাগে ঢোকার পরই ডাক্তার বললেন, ‘জিয়া ভাই আর নেই।’ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এত দ্রুত এমন দুর্ঘটনা ঘটে যাবে!
শোকের মধ্যেও মনে পড়ছে, জাতীয় দাবার শীর্ষ স্তরের প্রথম ম্যাচে আমি তাঁর সঙ্গে কিংস ইন্ডিয়ান ডিফেন্স খেলে জিতেছিলাম। তাঁর সঙ্গেই তাঁর জীবনের শেষ ম্যাচে সেই কিংস ইন্ডিয়ানই খেললাম। কিন্তু তাঁর শেষ ম্যাচটা শেষ হলো না। ম্যাচটা কেউ জেতেনি। আমরা শুধু তাঁকে হারালাম।
জিয়া ভাই পজিশনালি অনেক শক্তিশালী খেলোয়াড় ছিলেন। যে কারণে তাঁর সঙ্গে সহজে কেউ পারত না। রেকর্ড ১৪ বার জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তো সে কারণেই। সময়ের সঙ্গে তিনি তাঁর খেলার ধরন বদলেছেন। নতুন নতুন পদ্ধতিতে খেলার চেষ্টা করতেন, আক্রমণাত্মক খেলতেন।
এবারের জাতীয় দাবার ১১তম রাউন্ডে আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিলকে হারানো ম্যাচটাতে তিনি খুবই আক্রমণাত্মক খেলেছেন। আগে এত আক্রমণাত্মক খেলতে দেখিনি তাঁকে। বোঝা যেত, খেলাটা উপভোগ করছিলেন। তবে শেষ দিকে দেখেছি, নিজের খেলার চেয়ে বেশি চিন্তা ছিল ছেলে ফিদে মাস্টার তাহসিন তাজওয়ারকে নিয়ে। তাকে আরও কীভাবে খেলার সুযোগ করে দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে ভাবতেন। চোখ রাখতেন ছেলের বোর্ডের দিকে। আমার সঙ্গে শেষ ম্যাচের সময়ও পাশের বোর্ডে তাঁর ছেলে খেলছিল শাকিলের সঙ্গে।
খেলোয়াড় জিয়া ভাই সম্পর্কেই সবাই জানেন। তবে কোচ হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। কলকাতা থেকে ঢাকায় তাঁর বাসায় এসে অনেকে অনুশীলন করতেন। তাঁরা আন্তর্জাতিক মাস্টার, গ্র্যান্ডমাস্টারও হয়েছেন। ভারত থেকে অনেকে আমাকে ফোন করেছে, বার্তা পাঠিয়েছেন, তাঁরা শোকাহত। ভারতে সবাই তাঁকে অনেক শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। জিয়া ভাই না থেকেও থাকবেন আমাদের মধ্যে।
* এনামুল হোসেন রাজীব, গ্র্যান্ডমাস্টার