২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠান হয়েছিল ১২ আগস্ট। আগের দিন ১১ আগস্ট চীনের গুয়াংডং প্রদেশের হুইঝু শহরে কোরিয়ান পরিবারে জন্ম ঝেং হাওহাওয়ের। সেদিন কেউ কি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলেন, ১২ বছর পর আরেকটি অলিম্পিক মঞ্চে দেখা যাবে হাওহাওকে এবং সেটিও হয়ে যাবে ইতিহাসের অংশ?
প্লেস দে লা কনকর্ডে আজ মেয়েদের পার্ক স্কেটবোর্ডিংয়ে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে হাওহাও হয়ে গেল ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের সর্বকনিষ্ঠ অলিম্পিয়ান। চীনের ইতিহাসেও সবচেয়ে কম বয়সী অলিম্পিয়ান হওয়ার গৌরবময় কীর্তি গড়ল সে। বাংলাদেশ সময় আজ বিকেলে হাওহাও যখন স্কেটবোর্ড নিয়ে চীনকে প্রতিনিধিত্ব করতে নামে, তখন তার বয়স ১১ বছর ৩৬০ দিন। ১২তম জন্মদিনের কেক কাটার মাত্র ৫ দিন আগে নতুন কীর্তি গড়ল এই স্কেটবোর্ডার।
কদিন আগে ইকুয়াস্ট্রিয়ান ইভেন্টে নেমে প্যারিস অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি বয়সী অলিম্পিয়ানের রেকর্ড গড়েছেন হুয়ান আন্তোনিও হিমেনেজ কোবো। স্পেনের ৬৫ বছর বয়সী এই অলিম্পিয়ানের সঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ হাওহাওয়ের বয়সের ব্যবধান প্রায় ৫৪ বছর! ১১ বছর বয়সী হাওহাও বর্তমানে অলিম্পিক ইতিহাসেরও সবচেয়ে কম বয়সী স্কেটবোর্ডার।
সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ অলিম্পিয়ানের সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও ঢুকে পড়েছে হাওহাও। ১৮৯৬ সালে এথেন্সে অনুষ্ঠিত প্রথম অলিম্পিকে মাত্র ১০ বছর ২১৬ দিন বয়সে খেলতে নেমে সবচেয়ে কম বয়সী অলিম্পিয়ান হওয়ার কীর্তি গড়ে গ্রিসের জিমন্যাস্ট দিমিত্রিওস লুন্দ্রাস। ১৯৭০ সালে ৮৪ বছর বয়সে মারা যান লুন্দ্রাস। তবে তাঁর গড়া ১২৮ বছর আগের রেকর্ডটা এখনো টিকে আছে।
অলিম্পিকে সবচেয়ে কম বয়সে সোনার পদক জিতেছেন কে—এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধা আছে। তবে ইএসপিএন বলছে, কম বয়সে সোনা জয়ী অলিম্পিয়ানের নাম কিম ইউন–মি। দক্ষিণ কোরিয়ার এই স্পিডস্কেটার ১৯৯৪ সালে নরওয়ের লিলহ্যামারে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে যখন সোনা জেতে, তখন তার বয়স ছিল ১৩ বছর ৮৬ দিন।
কিম ইউন-মিকে ছাড়িয়ে হাওহাও সর্বকনিষ্ঠ সোনাজয়ী অলিম্পিয়ান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ২২ জনের প্রতিযোগিতায় ১৮তম হয়ে বাদ পড়েছে সে। আজ হাওহাওয়ের সেরা স্কোর ছিল ৬৩.১৯; যা তার ক্যারিয়ারসেরা স্কোরের ধারেকাছেও নয়।
হাওহাও চীনকে পদক এনে দিতে পারুক বা পারুক, এত অল্প বয়সে প্যারিস অলিম্পিকে খেলতে পারছে, সেটাই বা কম কী? আধুনিক অলিম্পিকে বেশ কয়েকটি ইভেন্টে খেলার ক্ষেত্রে বয়সসীমা আছে। যেমন জিমন্যাস্টিকসে ন্যূনতম ১৬ বছর, বক্সিংয়ে ন্যূনতম ১৮ বছর বয়স না হলে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। তবে স্কেটবোর্ডিংয়ে কোনো বয়সসীমা নেই। তাই হাওহাওয়ের প্যারিস অলিম্পিকে অংশ নিতে বয়স কোনো বাধা ছিল না; কিন্তু চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক।
মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথমবারের মতো স্কেটবোর্ড হাতে তুলে নেয় হাওহাও। ২০২০ সালে সে হুইঝু স্কেটবোর্ডিং দলে যোগ দেয়। চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা সিসিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে জানিয়েছিল, শুরুতে খেলাটা তার কাছে অদ্ভুত লাগলেও দ্রুতই মানিয়ে নেয়। বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবে সেই বছর সেভাবে অনুশীলন করতে না পারলেও পরের বছর চীনের জাতীয় গেমসে জায়গা করে নেয়। ২০২২ সালে গুয়াংডং প্রাদেশিক গেমসে হুইঝুর হয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে প্রথমবারের মতো পাদপ্রদীপের আলোয় আসে।
সেটিরই ধারাবাহিকতায় গত বছর মার্চে গুয়াংডং–হংকং–ম্যাকাও গ্রেটার বে এরিয়া স্কেটবোর্ড ওপেনে মেয়েদের পুল বোল ইভেন্টে প্রথম হয় হাওহাও। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুই মাস পরেই আর্জেন্টিনার সান হুয়ানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্কেটবোর্ডিং ট্যুরে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়।
দেশে ফেরার পর গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনটিতেই প্রথম হয় হাওহাও। জুনে চীন স্কেটবোর্ডিং ওপেনে ৩২.২০ পয়েন্ট তুলে সোনার পদক জেতে। আগস্টে জাতীয় রোলার স্কেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম হয় ৩০.২৭ স্কোর করে। নভেম্বরে জাতীয় যুব গেমসে ৬৪.৬৮ পয়েন্ট তুলে হয় দ্বিতীয়। তবে ডিসেম্বরে গুয়াংডং যুব স্কেটবোর্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতে বছর শেষ করে।
অলিম্পিকের বছর হওয়ায় ২০২৪ সালে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা দিতে হয়েছে হাওহাওকে। সব পরীক্ষায় ভালোভাবেই উতরে গেছে। সর্বশেষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২৩তম হওয়ার সুবাদে প্যারিস অলিম্পিক বাছাই পর্বে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় হাওহাও। গত মে মাসে সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত বাছাই পর্বের সিরিজে ৫১.৭৩ পয়েন্ট নিয়ে ৪৪ জনের মধ্যে ২০তম হয়। গত জুনে বুদাপেস্টে বাছাইয়ের পরবর্তী ধাপেও দারুণ পারফর্ম করলে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের ২৬তম অবস্থানে উঠে আসে এবং প্যারিসের টিকিট পেয়ে যায়।
প্যারিসের প্লেস দে লা কনকর্ডের পার্ক বোলে এক সপ্তাহ হলো অনুশীলন করছিল ঝেং হাওহাও। স্কেটবোর্ড নিয়ে হাওহাও যখন স্কেটপার্কে নামে, তখন তার মুখে লেগে থাকত চওড়া হাসি। দীর্ঘক্ষণ অনুশীলন করানোর পর কোচ যখন তাকে থামতে বলতেন, তখনো সেই হাসি। অন্য স্কেটবোর্ডারও হাওহাওকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান গত ২৬ জুলাই হলেও একাধিক ইভেন্ট শুরু হয়ে যায় ২৪ জুলাই থেকে। স্কেটবোর্ডিং ইভেন্ট শুরু হয়েছে এত দিন পর।
আসল পরীক্ষায় নামার অপেক্ষা ফুরাতে দেরি হচ্ছে কিংবা সর্বকনিষ্ঠ চীনা অলিম্পিয়ান হওয়ার কীর্তি গড়ার অপেক্ষা বাড়ছে কেন—সদা হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটার এ নিয়ে কোনো হেলদোলই ছিল না। ১১ বছর বয়সী কারও এমনটা হওয়ারও কথা নয়। তবে কাদের অনুসরণ করে এতদূর এসেছে সে কথা কয়েক মাস আগেই জানিয়েছে সে, ‘গ্রেট ব্রিটেনের স্কাই ব্রাউন, জাপানের হিরাকি কোকোনা, অস্ট্রেলিয়ার আরিসা ট্রিউয়ের মতো স্কেটবোর্ডারদের ভক্ত আমি। তাদের খেলার মধ্যে নানা ধরনের শৈলী আছে এবং তারা বিশ্বসেরা স্কেটবোর্ডারদের কয়েকজন।’
অস্ট্রেলিয়ার ট্রিউয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কও গড়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে হাওহাও, ‘আমি আরিসার (ট্রিউ) বন্ধু। আমি তার কাছ থেকে শিখতে চাই এবং তার মতোই ভালো করতে চাই। বিদেশের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গেলে তাদের (ব্রাউন, কোকোনা, ট্রিউ) সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি, কিছু পরামর্শ নিই। আমরা একসঙ্গে ঘুরে বেড়াই, নাচি এবং দুষ্টুমি করি।’
২০২০ টোকিও অলিম্পিকে জাপানকে রুপার পদক এনে দিয়েছিল কোকোনা, গ্রেট ব্রিটেনের হয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছিল ব্রাউন। আজ নিজের অলিম্পিক অভিষেকে তাদের সবাইকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছে হাওহাও।
ঝেং হাওহাওয়ের বর্তমান কোচ স্কেটবোর্ডিং কিংবদন্তি ড্যানি ওয়েনরাইট। তাঁর ছাত্রী হাওহাও জন্ম নেওয়ার আগেই এক্স গেমসে (অ্যাকশন স্পোর্টস সিরিজ) সম্ভাব্য ২৩ পদকের সব কটিই জিতেছেন ওয়েনরাইট। ছোট্ট হাওহাওয়ের এমন উত্থান নিয়ে ৪৯ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ কোচ অলিম্পিক ডটকমকে বলেছেন, ‘সে কঠিন পরিশ্রম করেছে বলেই খুব ভালো করছে।’
অলিম্পিক বাছাইয়ের আগমুহূর্তে হাওহাওয়ের দায়িত্ব নেন ওয়েনরাইট। তাঁর তত্ত্বাবধানে হাওহাও কতটা উন্নতি করেছে, সেটিও জানিয়েছেন, ‘আগে সে প্রতিযোগিতায় ৪৩তম অবস্থানে ছিল। আমি কোচ হওয়ার পর সে ২০তম হলো, তারপর ২১তম। আমার মনে হয়, সে সত্যিই দারুণ করেছে।’