হার্ভার্ডের স্নাতক আর অলিম্পিক ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে সোনা—এই দুটিকে কি মেলানো যায়? এত দিন যেত না। এখন যাচ্ছে। দুটি মিলে যা হয়, তার নাম কী, জানেন? গ্যাব্রিয়েল টমাস। সংক্ষেপে গ্যাবি টমাস।
২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড এমনিতেই একটা জায়গায় আলাদা হয়ে আছে। অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকের রং দেখে এত দিন অর্ণবের গানের সুরে একটাই প্রশ্ন করার ছিল—লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান? যেখানে প্যারিসে ট্র্যাকের রং লালও নয়, নীলও নয়—বেগুনি। উদ্দেশ্য, আলাদা হয়ে থাকা। অনেক বছর পরও ছবি বা ভিডিও দেখামাত্রই যাতে সবাই বুঝে ফেলতে পারেন, এটা প্যারিস ২০২৪। ট্র্যাকের টেকনিক্যাল অংশটাও বেগুনি, তবে রংটা একটু গাঢ়। আর বাঁকের পাশে বাড়তি জায়গাটা ধূসর। ১০০ বছর আগে প্যারিসে সর্বশেষ অলিম্পিকের অ্যাসফল্ট ট্র্যাকের রংটাও এমনই ছিল। সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেই এই রং।
গত পরশু রাতে স্তাদ দে ফ্রান্সের সেই বেগুনি ট্র্যাক অন্য রকম একটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল। টোকিও অলিম্পিকে একটি করে রুপা ও ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। যে একটা রঙের পদকই বাকি ছিল, সেটিও জিতে পদকের সেট পুরো করে ফেললেন গ্যাব্রিয়েল টমাস। এমন একটা দৌড়ে, যেটিতে ট্র্যাকের বাঁকটাও একবার ঘুরতে হয়। সেই বাঁকের পর থেকেই বলতে গেলে মেয়েদের ২০০ মিটারে কে জিতছেন, এ নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকেনি।
ইতিহাস অবশ্যই এটা নয়। অলিম্পিকের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে আরও কতজন এর চেয়ে আরও কত বড় কিছু করে রেখেছেন। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে টেলিভিশনে যাঁকে দৌড়াতে দেখে গ্যাব্রিয়েল টমাসের অ্যাথলেটিকসে আসা, সেই অ্যালিসন ফেলিক্স যেমন ৭টি সোনা, ৩টি রুপা আর ১টি ব্রোঞ্জ জিতেছেন।
তুলনাটা একটু বেখাপ্পাই হয়ে গেল। অ্যালিসন ফেলিক্সের মোট ১১ পদক অলিম্পিক ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডেই সবচেয়ে বেশি পদক জয়ের রেকর্ড। তারপরও তিন রঙের একটি করে মোট তিনটি পদকজয়ী প্রসঙ্গে ফেলিক্সকে টেনে আনার কারণ, নানিবাড়িতে টেলিভিশনে তাঁকে দেখেই ১১ বছরের কিশোরীর দৌড়ের প্রেমে পড়া।
অ্যালিসন ফেলিক্সের সেই কীর্তি ছোঁয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই গ্যাব্রিয়েল টমাসের। বয়স হয়ে গেছে ২৭। পরের অলিম্পিকেও তাঁকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এখানে পদক জিতলে আর একটাই জিততে পারেন। ১০০ মিটার রিলেটা বাকি আছে এখনো।
তবে ফেলিক্সের কীর্তি তো শুধুই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে সীমাবদ্ধ। গ্যাব্রিয়েল টমাসের যে ইতিহাস গড়ার কথা বলা হচ্ছে, তা সেই সীমানা ছাড়িয়ে অন্য ভুবনে ব্যাপ্ত। স্প্রিন্টে ভালো করাটা গ্যাব্রিয়েল টমাসের জীবনের লক্ষ্যের অগ্রাধিকার তালিকার প্রথমেই নেই। বরং সব সময়ই বলে এসেছেন, ট্র্যাকে দৌড়ানোটা তাঁর খণ্ডকালীন কাজ।
তা ভেবেছেন বলেই ২০১৯ সালে হার্ভার্ড থেকে স্নায়ুবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিতে পেরেছেন। তত দিনে ট্র্যাকে ভালো করতে শুরু করেছেন। আরও পড়াশোনার ‘ঝামেলা’য় না যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। অথচ গ্যাব্রিয়েল টমাস কিনা মাস্টার্স ডিগ্রিটাকেও জরুরি মনে করলেন। হিউস্টনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই ডিগ্রিটা মহামারিবিজ্ঞানে। সেটি ২০২৩ সালে। তত দিনে টোকিও অলিম্পিকের কল্যাণে তাঁর অ্যাথলেট পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠেছে।
যেকোনো খেলাই শীর্ষ পর্যায়ের অ্যাথলেটদের কাছ থেকে পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। গ্যাব্রিয়েল টমাস তাহলে কীভাবে পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে পারলেন? পড়াশোনাটা কোথায় হয়েছে, তা দেখলেই বুঝবেন, এটাকে শুধু চালিয়ে যাওয়া বলাটা ঠিক হবে না।
এখানেই আসছেন গ্যাব্রিয়েল টমাসের মা। বেড়ে ওঠার সময়টায় তাঁকে দেখেই গ্যাব্রিয়েল টমাস নিজের স্বপ্নের সীমানা অনেক বড় করে নেন। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর পাঁচ সন্তানকে বড় করে তোলার একক দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি পড়াশোনাও করে গেছেন জেনিফার র্যান্ডাল।
গ্যাব্রিয়েল টমাসের বয়স যখন ১০, তখন ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। এখন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। পরশু রাতে ‘টিম গ্যাব্রিয়েল টমাস’ লেখা টি–শার্ট গায়ে গ্যালারিতে বসে মেয়ের কীর্তি দেখলেন। পাশেই ছিলেন গ্যাব্রিয়েল টমাসের বয়ফ্রেন্ড স্পেন্সার ম্যাককানেসও। বয়ফ্রেন্ডও একাডেমিক পড়াশোনায় একই রকম উজ্জ্বল। স্পেন্সার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।
সবার আগে ফিনিশিং লাইন পেরোনোর পর আনন্দে-অবিশ্বাসে গ্যাব্রিয়েল টমাসের দুই হাত মাথায়। আরেকটা কারণের কথাও জানা গেল পরে। দৌড় শুরু করার পরই নাকি ‘ব্ল্যাকআউট’ হয়ে গিয়েছিল। পাশে কে কোথায় আছেন, তা বুঝতেই পারেননি। বুঝতে না পারার আরেকটা কারণও থাকতে পারে। দৌড় শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই তো গ্যাব্রিয়েল টমাসের পাশে কেউ নেই!