দারা তোরেসের নাম আপনি না–ও শুনে থাকতে পারেন। অলিম্পিকে ১২ পদকজয়ী, একসময় সাঁতারে তিনটি ইভেন্টে বিশ্ব রেকর্ডও ছিল তাঁর দখলে। প্রথম সাঁতারু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন পাঁচটি অলিম্পিকে। তাঁর কথাটা অলিম্পিকে শুধু কিশোর–কিশোরী নয়, বাকি অ্যাথলেটদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে, ‘তোমার স্বপ্নকে কখনো বয়স দিয়ে বেঁধো না!’
অলিম্পিক সেই ভুল করার জায়গাও না। সোনার স্বপ্ন দেখতে এবং তা বাস্তবায়নে সেখানে বয়স কোনো বাধা নয়। কিছু ডিসিপ্লিন তো এমন যেখানে কিশোর–কিশোরীদের প্রাধান্য; যেমন জিমন্যাস্টিকস। আর প্রতি আসরের মতো এবার প্যারিসেও আলো ছড়াতে শুরু করেছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের ব্র্যাকেটে বন্দী ‘টিনএজ’ অ্যাথলেটরা। এই বয়সের সীমারেখায় কতজন অলিম্পিয়ান প্যারিসে অংশ নিয়েছেন, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে একটি উদাহরণ দিয়ে মাত্রাটা বোঝানো যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯২ সদস্যের অলিম্পিক বহরে শুধু টিনএজ অলিম্পিয়ানই ৩২ জন। এরই মধ্যে সোনাও জিততে শুরু করেছেন কেউ কেউ।
জাপানের ১৪ বছর বয়সী কোকো ইয়োশিজাওয়ার কথাই ধরুন। এরই মধ্যে সে জাপানের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ অলিম্পিক সোনাজয়ী। গত পরশু মেয়েদের স্ট্রিট স্কেটবোর্ডে ‘অল টিনএজ’ ফাইনালে সোনা জিতেছে ইয়োশিজাওয়া। রুপাজয়ী জাপানেরই লিজ আকামার বয়স ১৫ বছর এবং ব্রোঞ্জজয়ী ব্রাজিলের রায়সা লিয়েলের ১৬। অর্থাৎ ১৪–তে সোনা, ১৫–তে রুপা এবং ১৬–তে ব্রোঞ্জ।
অলিম্পিক ময়দানের বাইরে ইয়োশিজাওয়া সেই কিশোরীদের মতোই, যে মজার খাবার এবং দর্শনীয় সব স্থানে ঘুরতে চায়। সোনা জয়ের পর ইয়োশিজাওয়া যেমন বলেছে, জয়টা উদ্যাপন করতে সে ‘র্যামেন’ খেতে চাওয়ার পাশাপাশি ‘ডিজনিল্যান্ডে’ ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। শুধু কি তাই, ইয়োশিজাওয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হলো স্কেটবোর্ডে চড়ে প্যারিস শহরটি ভালো করে ঘুরে দেখা।
২০২১ সালে অনুষ্ঠিত টোকিও অলিম্পিকে জাপানের সর্বকনিষ্ঠ ক্রীড়াবিদ হিসেবে এই একই ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন মোমিজি নিশিয়া। টিভিতে সেই জয় দেখা ইয়োশিজাওয়া তখন জানতেন না এটা অলিম্পিক গেমস! কিন্তু ১৩ বছর বয়সী মোমিজি তখন যে ‘ট্রিক’ (ফ্রন্টসাইড ব্রডসাইড স্পিন) দেখিয়ে সোনা জিতেছিলেন, সেটা তখনই আয়ত্ত করেছিলেন ষষ্ঠ গ্রেডে পড়া ইয়োশিজাওয়া। বাবা তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘কৌশল তো একই। তুমিও হয়তো একদিন অলিম্পিকে খেলবে।’
ভাইকে দেখে ৭ বছর বয়সে স্কেটবোর্ডিংয়ে যাত্রা শুরু ইয়োশিজাওয়ার। শুরুতে খেলাটা তার ভালো লাগত না, ‘ঘৃণা করতাম। পড়ে গেলে ব্যথা লাগত। ভাবতাম, লোকে কেন এটা খেলে!’ দুনিয়াজুড়ে কোভিড মহামারি শুরুর পর এই খেলায় সিরিয়াস হয় সে। কারণ? বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন না। বাবা মুঠোফোনও ছুঁতে দিতেন না। সময় তো কাটাতে হবে! শুরু হয় পার্কে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা করে অনুশীলন। ধীরে ধীরে উন্নতির গ্রাফে চড়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে পঞ্চম হয়ে ইয়োশিজাওয়া টিকিট পেয়ে যায় প্যারিস অলিম্পিকের। বাকিটা আপনি জানেন।
তবে যে বিষয়টি আপনি না–ও জানতে পারেন, স্কেটবোর্ডিং কম বয়সীদের খেলা—ইয়োশিজাওয়া এই প্রতিষ্ঠিত ধারণা ভেঙে ফেলতে চান। জুনিয়র হাইস্কুলে তৃতীয় বর্ষে পড়া এই স্কেটবোর্ডার বিজয়মঞ্চেই বলেছেন, ‘স্কেটবোর্ডারদের ব্যাপ্তি কম এবং গড় বয়সও কম হয়। আমি এই মানসিকতা পাল্টে প্রমাণ করতে চাই, বেশি বয়সেও অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি।’
ইয়োশিজাওয়ার গল্প থেকে বেরিয়ে আপনি বান হিওজিনের গল্পও শুনতে পারেন। ১৬ বছর বয়সী এই দক্ষিণ কোরিয়ান কিশোরী গতকাল মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে অলিম্পিক রেকর্ড ছুঁয়ে সোনা জিতেছেন। তাঁর গা থেকেও স্কুলের গন্ধ যায়নি। হাইস্কুলপড়ুয়া। এই বয়সে অলিম্পিকে দেশকে ১০০তম পদক এনে দেওয়ার—সেটাও যদি হয় সোনা আর জয়ের ব্যবধানও মাত্র .১—গৌরব বোঝার মতো বয়সই তো তাঁর হয়নি! কাঁচা বয়সের আবেগটাও কাঁচা। সোনা জয় নিশ্চিতের পর ভিজেছে চোখ। পরিবারকে দেশে রেখে এসে এই বয়সে অলিম্পিকের চাপ কাঁধে নিয়ে দেশকে জেতানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ২০২১ সালের আগে শুটিংয়ের সঙ্গে বানের পরিচয় ছিল না। তখন দেগুর স্কুলে খেলতেন তায়কোয়ান্দো। এক বন্ধু তাঁকে স্কুলের শুটিং দলে চেষ্টা করে দেখতে বলেছিল। দুই সপ্তাহর পর বান স্কুলের শুটিং দলে জায়গা পাওয়ার পর বুঝতে পারেন এই খেলায় তার ‘কিছুটা হলেও প্রতিভা আছে।’ কিন্তু তিন বছরের মধ্যে ‘অলিম্পিকে উঠে আসবেন, সোনা জিতবেন—তখন এমন কিছু একবারও ভাবেননি’। তবে স্বপ্ন তো ছিলই।
বান সেই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই আজ এই উচ্চতায়, যাকে বয়স দিয়ে বাঁধা যায় না!