এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের দুই অংশগ্রহণকারী বক্সার আবু তালহা (বামে), সেলিম হোসেন (ডানে)
এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের দুই অংশগ্রহণকারী বক্সার আবু তালহা (বামে), সেলিম হোসেন (ডানে)

৩৭ বছর আগের স্মৃতি বুকে নিয়েই বক্সিংয়ের এশিয়াড–যাত্রা

বাংলাদেশের খেলাধুলায় বক্সিংয়ের একটা আলাদা জায়গা আছে!

এশিয়ান গেমসে এখনো পর্যন্ত একমাত্র ব্যক্তিগত পদকটি এসেছিল এই বক্সিং থেকেই। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন মোশাররফ হোসেন। এরপর এশিয়াডে পদক এসেছে আরও, এসেছে সোনার পদকও। কিন্তু সবই দলীয় খেলায়। বেশির ভাগ পদকই এসেছে কাবাডিতে। সোনার পদকটি ২০১০ সালের গুয়াংজু এশিয়াডে, ক্রিকেটে। এশিয়াডে একমাত্র ব্যক্তিগত পদকের গর্বটা ৩৭ বছর ধরে শুধু বক্সিংয়েরই।

সামনে আরেকটি এশিয়ান গেমস। এ মাসেই চীনের হাংজুতে আয়োজিত এশিয়াডের ১৯তম আসরে বক্সিংয়ে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ। খুব বড় দল নয়। তিন সদস্যের ছোট্ট একটা দল। ছেলেদের ৫১ কেজি ফ্লাইটওয়েট ও ৫৭ কেজি ফেদারওয়েট আর মেয়েদের ৫০ কেজি ফ্লাইটওয়েট বিভাগে অংশ নেবে বাংলাদেশ। সঙ্গী ’৮৬ সিউল এশিয়াডে মোশাররফ হোসেনের সেই কীর্তি। কোচ শফিউল আজম মাসুদ বললেন, ‘এশিয়াড বক্সিংয়ের মান অনেক উন্নত, অলিম্পিকের পরপরই এর অবস্থান। এশিয়াডে আমাদের এমন সব প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হবে যাঁরা অলিম্পিকে পদক পায় নিয়মিত। এমন একটা জায়গায় আমাদের লক্ষ্য ভালো করা। আমাদের বক্সাররা যদি নির্দিষ্ট দিনে ভালো করতে পারে, তাহলে অনেক কিছুই হতে পারে।’

তালহা, সেলিম, আশাবাদী দুজনই

৫১ কেজি ফ্লাইটওয়েট বিভাগে অংশ নিচ্ছেন আবু তালহা। ৫৭ কেজি ফেদারওয়েটে সেলিম হোসেন। মেয়েদের ৫০ কেজি ফ্লাইটওয়েটে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বক্সার জিনাত ফেরদৌস। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি চীনে যাবেন এশিয়ান গেমসে অংশ নিতে। কোচ মাসুদ আশাবাদী তিন বক্সারকে নিয়েই, ‘সেলিম, তালহা দুজনই খুব ভালো করছে ইদানীং। আমি ওদের নিয়ে আশাবাদী। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিনাত সেখানে স্টেট পর্যায়ের ভালো বক্সার। এখানে তিন দিনের ট্রেনিংয়েও সে ভালো করেছে। আমি মনে করি ওদের দিয়ে ভালো কিছু সম্ভব।’

১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে বক্সিংয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন মোশাররফ হোসেন। বক্সিং ফেডারেশনের দেয়ালে গর্বের সঙ্গে টানিয়ে রাখা হয়েছে সেই ব্রোঞ্জজয়ের ম্যাচটির ছবি। এশিয়াডে এখনো পর্যন্ত এটিই যে একমাত্র ব্যক্তিগত পদক

এই ‘ভালো কিছু’ বলতে কোচ কত ভালো আশা করছেন! কোচ মাসুদের বক্তব্য পরিষ্কার, ‘দেখুন বক্সিং এক ঘুষির খেলা। অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। আমাদের বক্সারদের প্রস্তুতি ভালোই হয়েছে। পদকের আশা করি, এটা ঠিক বলব না। ওই যে বললাম, বক্সিং এক ঘুষির খেলা। তবে বক্সারদের মধ্যে ভালো কিছু করার তাড়না থাকতে হবে। সেটা আমি লক্ষ করেছি। বাকিটা রিংয়ে দেখা যাবে।’

সেলিম হোসেন লড়বেন ৫৭ কেজি ফেদারওয়েট বিভাগে

তিন বক্সারের মধ্যে সেনাবাহিনীর সেলিম হোসেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মোটামুটি অভিজ্ঞ। অংশ নিয়েছেন গত বছর বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমস ও ওয়ার্ল্ড আর্মি গেমসে। আবু তালহা সে তুলনায় নবীন। এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলবেন, তা–ও এশিয়ান গেমসের মতো আসরে। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিনাতও এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন।

সেলিম আর তালহা দুজনই রাজশাহীর বক্সার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ’৮৬ সিউল এশিয়াডে ব্রোঞ্জ জেতা বক্সার মোশাররফ হোসেনও রাজশাহীর। কোচ মাসুদের জন্মস্থানও রাজশাহী। দেশের ‘শিক্ষানগরী’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাজশাহী কি তাহলে বক্সিংয়ের রাজধানী? মাসুদ বললেন, ‘বক্সিংয়ের রাজধানী বলা যেতে পারে। প্রচুর বক্সার উঠে আসছে রাজশাহী থেকে। মোশাররফ ভাই তো রাজশাহীরই। ২০১০ সালে ঢাকার এসএ গেমসে সোনাজয়ী জুয়েল আহমেদ জনিও রাজশাহীর। ২০১৯ সালে কাঠমান্ডু এসএ গেমসে রুপাজয়ী রবিন মিয়া, ব্রোঞ্জজয়ী আরিফ হোসেন, আল আমিন ও সজীব—সবাই রাজশাহীর।’

আবু তালহা ৫১ কেজি ফ্লাইট ওয়েটে আশা জাগাচ্ছেন

সেলিম ও তালহা দুজনই আশাবাদী এশিয়াডে ভালো কিছু করবেন। সেলিমের কণ্ঠে এ নিয়ে থাকল প্রত্যয়ও, ‘দেশকে যদি কিছু দিতে পারি, তাহলে আমাদেরই লাভ। সবাই আমাদের চিনবেন। আমাদের সুযোগ–সুবিধা বাড়বে। আমরা দেশের কাছে কিছু চাইতে পারব। তাই সবার আগে সাফল্য দরকার। এশিয়ান গেমস কঠিন প্রতিযোগিতা। বক্সিংয়ের অনেক শীর্ষ দেশের বক্সারই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে। কিন্তু সাহস হারাচ্ছি না। বক্সিং রিংয়ে অনেক কিছু হতে পারে। দেখি না কী হয়!’

গত জুলাইয়ে দেশে এসেছিলেন এশিয়ান গেমসে মেয়েদের ৫০ কেজি ফ্লাইটওয়েটে নারী প্রতিযোগী জিনাত। মূলত জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সভাপতি বশির আহমেদ মামুনের সহায়তাতেই অ্যামেচার বক্সিং ফেডারেশন জিনাতকে পেয়েছে। ২৯ বছর বয়সী জিনাতের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তাঁর বাবার বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। মায়ের বাড়ি পাবনায়। ১৯৮৭ সালে এই দম্পতি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা জিনাতের। নিউইয়র্ক অঞ্চলে ৫০ কেজি ফ্লাইটওয়েট চ্যাম্পিয়ন জিনাত। বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন, ‘এশিয়াডে আমি বাংলাদেশকে সাফল্য উপহার দিতে চাই।’

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জিনাত ফেরদৌস এবার এশিয়ান গেমসে ৫০ কেজি ফ্লাইট ওয়েট বিভাগে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন

পল্টনের মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামের আবাসিক ক্যাম্পে সেলিম আর তালহাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন কোচ মাসুদ। স্বপ্ন দেখছেন জিনাত ফেরদৌসকে নিয়েও। কোচ হিসেবে তাঁর আশা এশিয়াডে কুড়িয়ে পাওয়া সাফল্য যদি দেশের বক্সিংকে আবারও আলোচনায় নিয়ে আসতে পারে, ‘বক্সিং খেলাটা খুব কষ্টকর। চোট পেয়ে, রক্তাক্ত হয়েই খেলতে হয় এটি। আমাদের বক্সাররা খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় না। অভিজ্ঞতায় তারা পিছিয়ে। এশিয়াডে যদি সাফল্য আসে, তাতে লাভ দেশের বক্সিংয়েরই। বেশি করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলার জন্য চাই পৃষ্ঠপোষকতা। বক্সিং ফেডারেশন চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা পৃষ্ঠপোষকদেরও সহযোগিতা চাই। আমাদের বক্সাররা সুযোগ পেলে দেশকে সাফল্য এনে দিতে পারবে।’

একটা সাফল্যের স্বপ্ন নিয়েই বক্সারদের কাটছে দিনমান!