উসাইন বোল্ট যেন ‘ব্ল্যাকহোল’। অ্যাথলেটিকস বিশ্বের পুরো আলোটাই যে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন সর্বকালের দ্রুততম মানব। ২০১৭ সালে বোল্টের অবসরের পর বিশাল এক শূন্যতায় ছেয়ে যায় অ্যাথলেটিকস। পরের ছয় বছরে অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতাগুলো যেন শুধুই নিয়ম রক্ষার জন্যই হয়েছে। দুটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ গেছে, গেছে একটি অলিম্পিকও। কিন্তু কে, কখন, কী জিতছেন—কজনই-বা সেটির খবর রেখেছেন! এমন একজন কিংবদন্তির বিদায়ে শূন্যতা হওয়ারই কথা। ট্র্যাকে ও ট্র্যাকের বাইরে ঝড় তোলার মতো কারও অপেক্ষায় ছিল বিশ্ব অ্যাথলেটিকস।
সেই অপেক্ষা হয়তো শেষ হতে চলেছে। একজন যে সদর্পে ঘোষণা করছেন, ‘আমার দিকে চোখ রাখুন।’ সেই একজনের নাম নোয়াহ লাইলস। বিশ্বের নতুন দ্রুততম মানব। গত পরশু হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্টার। আর তাতেই উসাইন বোল্টের বড় এক কীর্তি ছোঁয়ার খুব কাছে চলে গেছেন ট্র্যাকের বাইরেও কথার ঝড় তোলা লাইলস।
১০০ মিটার স্প্রিন্টটা কখনোই মূল ইভেন্ট ছিল না লাইলসের। প্রিয় ইভেন্ট ২০০ মিটার। এবার সেই ইভেন্টে জয়ের হ্যাটট্রিক করার স্বপ্ন নিয়েই বুদাপেস্টে গেছেন ২৬ বছর বয়সী অ্যাথলেট। শুধু ২০০ মিটার জিতলেই বোল্টের পর প্রথম স্প্রিন্টার হিসেবে বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটার জয়ের হ্যাটট্রিক করতেন। কিন্তু লাইলসের স্বপ্নটা তো আরও বড়। ১০০ মিটারও জিতে এখন ১০০-২০০ মিটারের ডাবল জয়ের সামনে তিনি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে যে কীর্তি গড়েছিলেন বোল্ট।
বুদাপেস্টে লাইলস সোনা জিততে সময় নিয়েছেন ৯.৮৩ সেকেন্ড। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ঘোষণা করেছিলেন, ৯.৬৫ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়াতে চান, ১৯.১০ সেকেন্ডে ২০০ মিটার।
১৯.১০! ২০০ মিটার স্প্রিন্টের বিশ্ব রেকর্ডই তো ১৯.১৯ সেকেন্ডের। ২০০৯ সালে বার্লিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেরই গড়া আগের রেকর্ড থেকে ০.১১ সেকেন্ড ছেঁটে ফেলেছিলেন বোল্ট। প্রিয় ইভেন্ট ২০০ মিটারে সেই রেকর্ড ভাঙাটাকেই পাখির চোখ করেছেন লাইলস।
১০০ মিটার স্প্রিন্টেও তো উসাইন বোল্ট ছাড়া অন্য কেউ ৯.৬৫ সেকেন্ডের নিচে দৌড়াতে পারেননি। সেটিও বোল্ট করতে পেরেছেন মাত্র দুবার। লাইলস তাঁর স্বপ্নের টাইমিংয়ের কথা জানিয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বুদাপেস্টে সংবাদ সম্মেলনে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রেড কার্লিকে তা জানিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন এক সাংবাদিক। স্প্রিন্টারদের স্বভাবসুলভ অহম দেখিয়ে কার্লি বলেন, ‘আমি ফ্রেড কার্লি, এই শিরোপাটা আমার। নোয়াহ যদি ৯.৬৫ দৌড়ায়, আমি আরও জোরে দৌড়াব!’ সেটি শুনে টেবিলের অন্য প্রান্তে বসা লাইলস টিপ্পনী কাটেন, ‘হারার আগে সবাই তা-ই বলে।’
লাইলস আর কার্লির লড়াই-ই তাই ১০০ মিটারের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ সেই লড়াইটা কিনা শেষ পর্যন্ত হয়ইনি! অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন মার্চেল ইয়াকবসের মতো কার্লিও যে ফাইনালেই উঠতে পারেননি। পরশু ফাইনালের আগে সেটিই ছিল বড় খবর।
লাইলস বোল্টের ‘ডাবলের’ কীর্তি ছুঁতে পারবেন কি না, সেটি জানা যাবে আগামী শুক্রবার। ২০০ মিটারের হিট শুরু হয়ে যাবে আগামীকাল থেকেই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দুবার ২০০ মিটার জিতলেও লাইলস কিন্তু টোকিও অলিম্পিকে নিজের প্রিয় ইভেন্টে তৃতীয় হয়েছেন। কেন, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পরশু নিজের দেখনদারি চরিত্রের প্রকাশও ঘটিয়েছেন লাইলস, ‘আমার মনে হয় না, দর্শকহীন টোকিও কতটা নির্জীব ছিল, এটা আপনারা বুঝতে পারবেন। মনে হচ্ছিল যেন মড়াবাড়ি।’ কোভিডের কারণে শূন্য গ্যালারির সামনে জয়ের তাড়নাই নাকি ছিল না তাঁর!
অনেক সময়ই বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন কাটা পড়ত। ডিনারে খুব একটা বৈচিত্র্য কখনোই থাকত না। মানুষের বাড়ি থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার অবশ্য আসত প্রচুর। মা কী পরিশ্রমই না করতেন!নোয়াহ লাইলস, বিশ্বের দ্রুততম মানব
সেই লাইলস পরশু ১০০ মিটার স্প্রিন্টে জয়ের পর পরশু অর্গল খুলেছেন নিজের অতীত নিয়েও। ছেলেবেলায় কী কঠিন অসুখে ভুগেছেন, তাঁর জীবনে মায়ের ভূমিকা—সবকিছুই বলেছেন।
ছেলেবেলায় অসুখবিসুখ লেগেই থাকত। সেই প্রসঙ্গেই মায়ের কথা বললেন লাইলস, ‘মা (হাসপাতালে) আসতেন। প্রতিটা রাতই নির্ঘুম কাটত। আমার যে ঘুম পেত না। বয়স যখন চার, তখন থেকে প্রায়ই মাঝরাতে চিকিৎসকের কাছে আর হাসপাতালে যেতে হতো।’
লাইলসের ছেলেবেলাতেই বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁর মা-বাবার। মা কত কষ্ট করে তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন, সেটিও বলেছেন লাইলস, ‘অনেক সময়ই বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন কাটা পড়ত। ডিনারে খুব একটা বৈচিত্র্য কখনোই থাকত না। মানুষের বাড়ি থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার অবশ্য আসত প্রচুর। মা কী পরিশ্রমই না করতেন!’
অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডারও (এডিএইচডি) ছিল লাইলসের। মায়ের পরামর্শে ছবি আঁকায় মন দিয়ে মানসিক অস্থিরতার সেই রোগ থেকে সাময়িক মুক্তি মিলত তাঁর।
পরশু বিশ্বের দ্রুততম মানব হওয়ার পর সেই লাইলস গ্যালারিতে থাকা মাকে বলেছেন, ‘আমি এখন উড়ছি, মা।’