ফুটবল–রাগবি শুরু হয়ে গেছে, অন্য আরও কিছু খেলার প্রাথমিক পর্বও। তারপরও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার আগে অলিম্পিক শুরুর আমেজটা আসে না। বিশেষ করে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সব সময়ই বড় একটা আকর্ষণ হয়ে থাকে। এবার তা আরও বেশি, কারণ এই প্রথমবারের মতো অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে স্টেডিয়ামের বাইরে। সম্প্রতি প্যারিস অলিম্পিকের আয়োজক কর্তৃপক্ষ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি ধারণাও দিয়েছে, তবে চমক হিসেবে অনেক কিছুই গোপন রাখা হয়েছে।
অলিম্পিকের উদ্বোধনী প্যারেডের জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় প্রধান অ্যাথলেটিক স্টেডিয়াম। কিন্তু প্যারিস অলিম্পিকের আয়োজকেরা এবার সেটিকে রাজধানীর কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মূলত অলিম্পিকের মূল থিম ‘গেমস ওয়াইড ওপেন’কে সামনে রেখেই এই সিদ্ধান্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে সিন নদীতে। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ৬-৭ হাজার অ্যাথলেট আইফেল টাওয়ারের পূর্ব কোণের অস্টারলিটজ সেতু থেকে নৌকা ও বার্জে করে সিন নদীর ৬ কিলোমিটার পাড়ি দেবেন।
প্রায় ৫ লাখের বেশি দর্শক বিশেষভাবে তৈরি স্ট্যান্ড থেকে এই আয়োজন উপভোগ করবেন। এরই মধ্যে ২ হাজার ৭০০ ইউরোর বেশি দামে বিক্রি হয়েছে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট। তবে সিনের তীর ও আশপাশের ভবনের বারান্দা থেকেও বিনা মূল্যে উপভোগ করা যাবে বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠান।
এ মাসের শুরুতে আয়োজক কমিটির প্রধান টনি এস্তানগুয়ে এএফপিকে বলেন, সিন নদীতে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা স্টেডিয়ামে আয়োজনের চেয়ে কঠিন। তবে এটি আরও বেশি আকর্ষণীয় হবে। মূলত অনুষ্ঠানস্থলের আকার ও প্যারেড আয়োজনের জটিলতার কারণে কাজটা কঠিন বলে জানিয়েছেন এস্তানগুয়ে। তা ছাড়া পূর্ণাঙ্গভাবে মহড়া দিতে না পারাও কাজটাকে জটিল করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
শুক্রবার প্যারিসের সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা (বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ৩০ মিনিটে) শুরু হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। চার ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বর্ণাঢ্য আয়োজনটি। সূর্যাস্তের সময় আর এই আয়োজনের শেষ অংশটা মিলে যাবে। আয়োজকদের জন্য সুখবর, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী শুক্রবার বিকেলে প্যারিসের আবহাওয়া থাকবে দারুণ।
ঐতিহ্য মেনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবার আগে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে অলিম্পিকের জন্মভূমি গ্রিসকে। তাদের পর দেখা যাবে শরণার্থী অলিম্পিক দলকে। আর সবার শেষে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে আয়োজক দেশ ফ্রান্সকে। অন্যদিকে রাশিয়া ও বেলারুশের অ্যাথলেটরা এই আয়োজনে অংশ নেবেন ব্যক্তিগত পরিচয়ে। ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের ভূমিকার কারণে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে রাশিয়া ও বেলারুশকে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজনটি পরিকল্পনা করছেন প্রখ্যাত থিয়েটার পরিচালক টমাস জলি। ৪২ বছর বয়সী জলি সুপারহিট রক-অপেরা সংগীতের অনুষ্ঠান ‘স্টারম্যানিয়া’র পরিচালক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। তাঁর দলে ফরাসি টিভি সিরিজ ‘কল মাই এজেন্ট’ অনুষ্ঠানের লেখক ফ্যানি হেরেরোও আছেন। আরও আছেন জনপ্রিয় লেখক লেইলা স্লিমানি ও বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্যাটট্রিক বুচেরোনে।
এএফপি জানিয়েছে, পুরো অনুষ্ঠানটিকে ১২টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেখানে মোট তিন হাজার নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী ও বিনোদনকর্মী অংশ নেবেন। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা সিনের দুই তীরে, সেতুতে ও কাছাকাছি স্মৃতিস্তম্ভগুলোয় থাকবেন। নটর ডেম ক্যাথেড্রালও থাকবে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে, ২০১৯ সালে ভয়ংকর এক অগ্নিকাণ্ডের পর যেটি এখন পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দুই–তৃতীয়াংশ আয়োজন দিনের আলোয় আয়োজন করা হলেও বাকি অংশ দেখা যাবে গোধূলিবেলায়। জলির প্রত্যাশা, এই আয়োজনে প্যারিসের অপরূপ সূর্যাস্তের মুহূর্তও প্রাণভরে উপভোগ করতে পারবেন দর্শকেরা।
প্যারেডের পাশাপাশি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সংগীত আয়োজনও বড় আকর্ষণ। তবে সংগীতের অংশে কিছু বিতর্কও আছে। যেমন ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের আপত্তির পরও প্রখ্যাত ফরাসি সংগীতশিল্পী আয়া নাকামুরার অন্তর্ভুক্তিতে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। ফরাসি রাজনীতিবিদ মারিন লে পেন বলেছেন, ‘অলিম্পিক আয়োজনে নাকামুরার অংশগ্রহণ ফ্রান্সের জন্য অপমানজনক হবে।’
গত সপ্তাহে নিজেদের আয়োজনকে এক শব্দে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘ভালোবাসা’র কথাই বলেছেন জলি। রক্ষণশীলদের আপত্তি ও বিরক্তির পরও জলি বলেছেন, তাঁরা এই আয়োজনে ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক, ভাষিক, ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরতে দৃঢ়প্রত্যয়ী।
পাশাপাশি জলির দল বৈশ্বিক মানবাধিকারের ধারণা এবং গণতন্ত্রের বিকাশে ফ্রান্সের ঐতিহাসিক অবদানকেও অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে চায়। হেরেরো বলেছেন, ‘আমরা মানুষকে ভাষণ শোনানোর যে সহজাত প্রবৃত্তি, তা এড়িয়ে যেতে চাই।’ বুচেরোনে বলেন, ‘২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে যেমনটা হয়েছিল, আমরা তা করতে চাই না।’ উল্লেখ্য, ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে তিন ঘণ্টাব্যাপী চীনা জাতীয়তাবাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে সমালোচনার মুখে পড়েছিল আয়োজক কর্তৃপক্ষ।
বিতর্কের পরও আয়া নাকামুরাকে রাখা এবারের অলিম্পিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাই তাঁর পারফরম্যান্সের দিকে নিশ্চিতভাবে অনেকেরই দৃষ্টি থাকবে। পাশাপাশি সিনের নদী থেকে সাবমেরিন ভেসে ওঠার আভাসও দিয়েছেন জলি। সেটিও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় একটি অংশ হবে। জলি বলেছেন, ‘আমাদের হাতে আকাশ আছে, সেতু আছে, পানি আছে, নদীর তীর আছে। কাব্যিক ব্যঞ্জনায় অনুষ্ঠানকে রাঙানোর জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট জায়গা আছে। তাহলে আমরা নদীর তলদেশকেও কেন ব্যবহার করব না।’
তবে সবকিছু সফল হবে, যদি সবাই অনুষ্ঠান শেষে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। আর এই সফলতা নিশ্চিত করতে ফরাসি পুলিশও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এত বেশিসংখ্যক মানুষের নিরাপত্তার কথাটি আলাদা করে ভাবতে হচ্ছে তাদের। জানা গেছে, প্রায় ৪৫ হাজার নিরাপত্তাকর্মী পুরো অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন।