প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের সামনে অনুশীলনে ব্যস্ত চীনা ম্যারাথনবিদ লুয়ান ইউশুয়াই
প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের সামনে অনুশীলনে ব্যস্ত চীনা ম্যারাথনবিদ লুয়ান ইউশুয়াই

ম্যারাথনে দেখিয়ে দিতে চান চীনের ‘দ্রুততম ডেলিভারি ম্যান’

ম্যারাথনের প্রস্তুতি নেওয়ার একপর্যায়ে বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের সামনে দিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন লুয়ান ইউশুয়াই। এই রুট ধরেই হবে প্যারিস অলিম্পিকের ম্যারাথন লড়াই। সেখানেই বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে কথা হয় চীনের অপেশাদার ম্যারাথনবিদ লুয়ানের। আগামী ১০ আগস্ট তাঁর সঙ্গে দৌড়াবেন আরও ২০ হাজার ২৪ জন পুরুষ!

মূলত ম্যারাথনকে গণমানুষের ইভেন্ট হিসেবে তুলতে ধরতেই প্রথমবারের মতো পেশাদার অ্যাথলেটদের সঙ্গে অপেশাদারদেরও দৌড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে অলিম্পিকের আয়োজক কমিটি। লুয়ান সেই অপেশাদার অ্যাথলেটদেরই একজন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, প্যারিস অলিম্পিকে ১০ হাজার ৫০০ পেশাদার অ্যাথলেট থাকতে হঠাৎ লুয়ানের মতো একজন অপেশাদারকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?

গল্পটা তাহলে শুরু থেকেই বলা যাক।

কদিন আগে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে লুয়ানকে পরিচয় করিয়ে দেয় তাঁর দেশ চীনের দৈনিক সংবাদপত্র ‘দাঝং’। এরপর তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া এবং হংকংভিত্তিক ইংরেজি ভাষার দৈনিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

৯ বছর ধরে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ডেলিভারি ম্যানের কাজ করছেন লুয়ান ইউশুয়াই

সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, চীনের জিলিন প্রদেশের ছোট্ট এক পার্বত্য গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন লুয়ান ইউশুয়াই। ৩৯ বছর বয়সী লুয়ান চীনের ‘দ্রুততম ডেলিভারি ম্যান’ হিসেবে পরিচিত। সবার আগে মানুষের দুয়ারে পার্সেল পৌঁছে দেন তিনি। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ৯ বছর ধরে দিনে ১২ ঘণ্টা করে এ কাজেই ব্যস্ত থাকেন। আর সুযোগ পেলেই ম্যারাথনের প্রস্তুতি নেন। প্রতি মাসে তিনি ৪০০ কিলোমিটার দৌড়ান। সেই লুয়ান এবার প্যারিস অলিম্পিকের ম্যারাথনে অংশ নিতে যাচ্ছেন।

প্যারিস অলিম্পিকের ম্যারাথনে পেশাদার অ্যাথলেটের সঙ্গে দৌড়াতে বিশ্বজুড়ে ৮০ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়ে। যোগ্যতার ভিত্তিতে সেখান থেকে নারী–পুরুষ মিলিয়ে বাছাই করা হয় ৪০ হাজার ৪৮ জনকে। লটারির মাধ্যমে চীন থেকে সুযোগ পান ১২০ জন। লুয়ান সেই সৌভাগ্যবানদের একজন।

প্যারিসে যাওয়ার আগে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে লুয়ান বলেছিলেন, ‘আমি অলিম্পিকে দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই। এটার জন্য মুখিয়ে আছি।’

গত সোমবার ল্যুভর জাদুঘরের সামনে অনুশীলন করার সময় রয়টার্সের সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হতেই মনের ঝাঁপি খুলে দেন লুয়ান, ‘প্রথমবার প্যারিসে এসেছি, প্রথমবার দেশের বাইরে দৌড়াচ্ছি। একজন অপেশাদার অ্যাথলেট হিসেবে এত বড় মঞ্চে দৌড়ানোর সুযোগ পেয়ে নিজেকে সত্যিই সৌভাগ্যবান মনে করছি। এটা আমার জন্য সম্মানের। আমি যতটা দ্রুত সম্ভব দৌড়ানোর চেষ্টা করব। একজন ডেলিভারি ম্যান কী করতে পারে, তা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাই।’

প্যারিস অলিম্পিক ম্যারাথনে নিজের সেরা টাইমিং করতে চান লুয়ান ইউশুয়াই

বেড়ে ওঠার বয়সেও খেলাধুলা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিল না লুয়ানের। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে পর্বতে খরগোশ শিকারে যেতেন—এই যা।

লুয়ানের ম্যারাথন যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালে। অন্য দিনগুলোর মতোই একদিন তিনি পার্সেল পৌঁছে দিতে ছুটছিলেন। এমন সময় তাঁর অফিসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাঁকে ফোন করে বলেন, বেইজিং ম্যারাথনে অংশ নিতে হবে। বসকে কি আর ‘না’ বলা যায়! ব্যস, সেই থেকে শুরু ম্যারাথন যাত্রা।

রয়টার্সকে সে কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের কোম্পানির নাম জেডি লজিস্টিকস। এটি বেইজিং ম্যারাথনে নানা ধরনের সেবা দিয়ে থাকে এবং সেই প্রতিযোগিতায় আমাদের কোটা আছে। আমার মনে হয়েছিল, আমি সব সময় খুব দ্রুত কাজ করি। তাই (কোম্পানির পক্ষ থেকে) আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।’

জেডি লজিস্টিকস কোম্পানিতে চাকরি করেন লুয়ান ইউশুয়াই

নিজের প্রথম ম্যারাথনে ৩০ কিলোমিটার দৌড়ানোর পর লুয়ানের শরীর আর যেন চলছিল না, পা দুটি অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। তিনি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে ৪ ঘণ্টা ২৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে দৌড় শেষ করেন। তখন থেকেই খেলার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন, ‘আমি ভেবেছিলাম ম্যারাথন শুধু পেশাদারদের জন্য। কিন্তু যখন আমি ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে গেলাম, তখন নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব বোধ হলো এবং আমি নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম।’

ম্যারাথন নিয়ে লুয়ানের আগ্রহের কথা ধীরে ধীরে জানতে পারেন তাঁর পৌঁছে দেওয়া পণ্যের গ্রাহকেরাও । নিয়মিত পণ্য নেওয়া এক ক্রেতাই ছিলেন তাঁর প্রথম কোচ। সেই কোচ তাঁকে ব্যায়াম ও পুষ্টি সম্পর্কেও নির্দেশনা দেন। কোচের সান্নিধ্য পেয়ে লুয়ানও উন্নতি করতে শুরু করেন। শক্তি ও মনোবল বাড়াতে পায়ে বালির ব্যাগ বেঁধে অনুশীলন করেন থাকেন। দুই বছরের মধ্যে তিনি ম্যারাথন প্রতিযোগিতা শেষ করার সময় প্রায় দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনেন। চীনের বেশ কয়েকটি ট্রেকিং (হাইকিং) রেসে চ্যাম্পিয়নও হন। ২০২০ সালে নানজিং ম্যারাথনে ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজের সেরা টাইমিং করেন।

প্যারিস অলিম্পিক ম্যারাথনে অপেশাদার অ্যাথলেটদেরও সুযোগ দেওয়া হবে—খবরটা পাওয়ার পর থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন লুয়ান। কিন্তু লটারিতে ভাগ্য পরীক্ষার আগেই আরও বড় পরীক্ষা দিতে হয় তাঁকে। আবেদনের যোগ্যতা অর্জন নির্ভর করে ফিটনেস পয়েন্টের ওপর। ফিটনেস পয়েন্ট বাড়াতে তিনি ২০২৩ সালের পুরোটাই কাজ শেষে রাতে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার দৌড়ানো শুরু করেন।

ফিটনেস পয়েন্ট বাড়িয়ে প্যারিস অলিম্পিকে জায়গা করে নিতে রাতেও অনুশীলন করেছেন লুয়ান ইউশুয়াই

লুয়ানের পরিশ্রম অবশেষে সার্থক হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে চীনা নববর্ষের ঠিক আগে ফোনে একটি বার্তা পান। সেই বার্তা অনুবাদ করার পর বুঝতে পারেন প্যারিস অলিম্পিক ম্যারাথনে তাঁকে নির্বাচন করা হয়েছে। অলিম্পিক ম্যারাথনের জন্য সম্ভাব্য সেরা প্রস্তুতি নিতে কিছু দিন হলো ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার বেশি দৌড়াচ্ছেন। সঙ্গে খাদ্যতালিকায় আরও বেশি প্রোটিন যোগ করেছেন।

এবার সত্যি সত্যিই বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার সময় লুয়ানের।