কোনো খেলোয়াড় তাঁর হেরে যাওয়া ম্যাচের গল্প এত আনন্দ নিয়ে করতে পারেন, সেটি জুলিয়াস ফ্রান্সিসকে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবেন না। ২৪ বছর আগে ম্যাচটি হেরেছিলেন সে সময়ের ব্রিটিশ হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। ম্যানচেস্টার অ্যারেনায় সেদিন এমন বিপর্যস্ত হয়ে ফ্রান্সিস হেরেছিলেন, ম্যাচটি তাঁর ভুলে থাকতে চাওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরও সেই দিনটি, সেই মুহূর্তটি নাকি তাঁর জীবনের সেরা!
ব্রিটিশ হেভিওয়েট বক্সার ফ্রান্সিস হোটেল লা মেরিডিয়ানের ছাদে বসে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর চোখেমুখে তৃপ্তির একটা আভা। অথচ সাবেক কমনওয়েলথ বক্সিং চ্যাম্পিয়নের সেই ম্যাচে তৃপ্তি পাওয়ার মতো কিছু ছিলই না। সেই ম্যাচে তিনি হেরেছিলেন মাইক টাইসনের কাছে। মাত্র পাঁচ ঘুষিতেই সেই ম্যাচটা শেষ করেছিলেন হেভিওয়েট বক্সিংয়ের কিংবদন্তি টাইসন।
জুলিয়াস ফ্রান্সিস ঢাকায় এসেছেন বাংলাদেশ প্রফেশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে। কাল সন্ধ্যায় হোটেল লা মেরিডিয়ানের ছাদে বসেছিল পেশাদার বক্সিংয়ের এক আয়োজন। ওয়ার্ল্ড বক্সিং কাউন্সিল (ডব্লুবিসি) ও ওয়ার্ল্ড বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লুবিএ) বেল্টের লড়াই। সেখানেই অতিথি হয়ে এসেছেন সাবেক এই ব্রিটিশ হেভিওয়েট বক্সার। ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি ম্যানচেস্টারে সেই লড়াইয়ে ফ্রান্সিসকে পাঁচটি দশাসই ঘুষি হাঁকান মাইক টাইসন। ফ্রান্সিস কাল নিজেই সেই ঘুষির বর্ণনা দিলেন, ‘ভয়াবহ ছিল সেই ঘুষিগুলো। আমার মাথা ঘোরা শুরু করেছিল। ৫৮ সেকেন্ড লড়েছিলাম টাইসনের বিপক্ষে। রেফারি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আর দুটি ঘুষি খেলে আমি হয়তো আর এখানে থাকতাম না।’
ভয়াবহ এই বর্ণনা দেওয়ার সময় ফ্রান্সিস হাসছিলেন। ঘুষি খেতে এত মজা? এমন প্রশ্নে প্রশ্নকারীর বোকামিতে যেন অবাক ব্রিটিশ হেভিওয়েট, ‘আরে ওই সময় মাইক টাইসনের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম বুকের পাটা ছিল বলেই। আর আমার কাছে সেই লড়াইটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। আমি জিতব না, জেনেই নেমেছিলাম। তবে বক্সিং ম্যাচটা মাত্র চার মিনিট স্থায়ী হয়েছিল বলে কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলাম। হাজার হোক, লোকে তো টিকিট কেটে ম্যাচটা দেখতে এসেছিল।’
টাইসনের সঙ্গে লড়াইয়ের সেই স্মৃতি তো এমনিতেই ভোলার বিষয় নয়। তার ওপর ম্যাচটা তাঁর মনে বিশেষ দাগ কেটে আছে আরেকটি কারণে। তার কিছুদিনের মধ্যেই যে ছেলের বাবা হয়েছিলেন ফ্রান্সিস, ‘টাইসনের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সময় ২৪ বছরে পা রেখেছি। আমার ছেলের জন্মও ২০০০ সালেই।’
১৯৯৭ সালে বক্সিংয়ের আরেক কিংবদন্তি ইভান্ডার হলিফিল্ডের সঙ্গে লড়াইয়ে অদ্ভুত এক কাণ্ড করেছিলেন মাইক টাইসন। হলিফিল্ডের সঙ্গে পেরে না উঠে তাঁর কান কামড়ে ধরেছিলেন। ‘দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মানুষ’ তকমাটা টাইসন এমনি এমনি পাননি। জুলিয়াস ফ্রান্সিসের সঙ্গে লড়াইটা তাঁর তিন বছরের মাথায়। হলিফিল্ডের কান সেদিন কেন কামড়ে ধরেছিলেন টাইসন, সেটি এখনো এক বিস্ময়।
তবে যে বক্সার তাঁর ক্যারিয়ারে ৫৮টি পেশাদার বক্সিং ম্যাচের ৫০টিতেই জিতেছেন, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত—টানা হেভিওয়েট বক্সিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের উপাধিটা ধরে রেখেছিলেন, তাঁর সঙ্গে লড়তে নামার আগে কোনটি বেশি মাথায় ছিল ফ্রান্সিসের? তাঁর কথা, ‘টাইসন হয়তো জীবনে অনেক ভুল করেছেন। তিনি কিছু অন্যায়ও করেছেন। তবে বিশ্বাস করুন, সেদিন তাঁর বিপক্ষে যখন রিংয়ে নামি, তখন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ছাড়া আর কিছুই মাথায় ছিল না। সেই সঙ্গে ছিল একধরনের শ্রদ্ধাবোধ।’
টাইসনের সঙ্গে সেদিন ম্যাচের আগে কোনো কথাই হয়নি। সেটির প্রশ্নও ওঠে না। তবে চার মিনিটে লড়াইটা শেষ করে দিয়ে টাইসনের হয়তো সেদিন কিছুটা মায়াই লেগেছিল। তাই ফ্রান্সিসের খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন তিনি। বেশ খানিকটা আলাপও হয়েছিল সেই সময়, ‘উনি আমার খোঁজ নিয়েছিলেন। খুব বেশি ব্যথা পেয়েছি কি না! লোকটার সঙ্গে যখন কথা বললাম, তখন কেবলই মনে হচ্ছিল, এই মানুষটা কীভাবে রিংয়ে হলিফিল্ডের কান কামড়ে ধরতে পারেন, কীভাবে তাঁর ক্যারিয়ারটা বিতর্কে বিতর্কে জর্জরিত হতে পারে! সে এক বিস্ময়!’
বাংলাদেশে এসেছেন পেশাদার বক্সিংকে সবার মধ্যে কিছুটা পরিচিত করাতে। শৌখিন বক্সিংয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি বক্সাররা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পেশাদার বক্সিংয়ে খুব বেশি দিন নয় পথচলা। আল–আমিন হোসেন কিংবা সূরকৃষ্ণ চাকমারা হয়তো কিছুটা নাম কুড়িয়েছেন। কিন্তু পেশাদার বক্সিংয়ের অবস্থাটা এখনো হাঁটি হাঁটি পা পা।
ফ্রান্সিস কেমন দেখছেন বাংলাদেশের পেশাদার বক্সিং আয়োজনকে? তাঁর উত্তর, ‘বাংলাদেশ বক্সিংয়ে বিশ্বদরবারে পরিচিত নয় সেভাবে। এই দেশ ক্রিকেটে বিশ্বকাপ খেলে। এ দেশে বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরি হয়, এটা জানি। আমি এসেছি পেশাদার বক্সিংকে এগিয়ে নিতে। বাংলাদেশ প্রফেশনাল বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনকে সাহায্য করতে। সময় লাগবে। বক্সিং নিয়ে আগ্রহ তৈরি করতে হবে সবার মধ্যে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। ক্রিকেটে যদি এই দেশ বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি করতে পারে, তাহলে বক্সিংয়েও পারবে।’
ক্রিকেট বাংলাদেশে এক নম্বর খেলা। কিন্তু ফুটবল অত্যন্ত জনপ্রিয়, এমন তথ্যে কিছুটা অবাক ব্রিটিশ হেভিওয়েট বক্সার, ‘আমি বাংলাদেশ ফুটবল দলের খেলা কখনো দেখিনি। তবে ক্রিকেট দলের খেলা দেখেছি। ক্রিকেট তো ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপেও খেলেছে।’
ফুটবল বিশ্বকাপে না খেললেও বাংলাদেশ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলে, এটা জানার পর ফ্রান্সিসের আরেকবার বিস্মিত হওয়ার পালা, ‘আমি আসলেই জানতাম না বাংলাদেশ ফুটবল খেলে। যা–ই হোক, বাছাইপর্বে যখন খেলছে, তখন খুব খারাপ দল হয়তো তারা নয়। বাংলাদেশ ফুটবলে আরও এগিয়ে যাক। ভালো খেলুক। তবে বক্সিংটাও যেন এ দেশের মানুষ আপন করে নেন, এটাই চাই।’