সোনা জয়ের পর সিডনি ম্যাকলাফলিন–লেভরোন
সোনা জয়ের পর সিডনি ম্যাকলাফলিন–লেভরোন

গণিতের হিসাবে দৌড়, ম্যাকলাফলিন-লেভরোন রেকর্ড ভেঙেই চলেছেন

বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ৪০০ মিটার হার্ডলস কীভাবে জিততে হয়?

সিডনি ম্যাকলাফলিন–লেভরোন এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারেন, এ আর এমন কী! দৌড়ের সময় ৪০০ মিটার দূরত্বের মাঝে যে ১০টি হার্ডলস থাকে, সেগুলো টপকে যাওয়াতে মনোযোগ দাও। পা আপনাই ছুটবে।

বিশ্বাস হচ্ছে না? যুক্তরাষ্ট্রের এই অ্যাথলেট গতকাল রাতে এভাবেই মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলসে সোনা জিতেছেন। সেটাও নিজেরই গড়া বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে। ম্যাকলাফলিন–লেভরোন এখন অলিম্পিকের ৪০০ মিটার হার্ডলসে টানা দুটি সোনাজয়ী প্রথম নারী। এই ইভেন্টে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও প্রতিদ্বন্দ্বী নেদারল্যান্ডসের ফেমকে বোলকে পেছনে ফেলে ৫০.৩৭ সেকেন্ডে সোনা জেতেন ‘সুপার সিড’ নামে খ্যাতি পাওয়া ২৫ বছর বয়সী এই অ্যাথলেট। গত জুনে ইউজেনিতে অলিম্পিক ট্রায়ালে নিজের গড়া ৫০.৬৫ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ডও ‘সুপার সিড’ লিখেছেন নতুন করে।

নিজের গড়া কীর্তির পাশে দাঁড়িয়ে সিডনি ম্যাকলাফলিন–লেভরোন

অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, এই ডিসিপ্লিনে গত পাঁচ বছরে ম্যাকলাফলিন–লেভরোনকে কেউ হারাতে পারেননি। বার্তা সংস্থা এএফপি তো সোজাসাপ্টাই বলে দিয়েছে, ৪০০ মিটারে মেয়েদের সর্বকালের সেরা হার্ডলার হিসেবে নিজের জায়গা আরও শক্ত করলেন ম্যাকলাফলিন–লেভরোন। কিন্তু তারপর? জায়গা তো পাকা হলো, তারপর কী? গতকাল জয়ের পর সেটাও বলেছেন ম্যাকলাফলিন–লেভরোন। নিজের টাইমিং নামিয়ে আনতে চান ৫০ সেকেন্ডের নিচে।

তাঁর কথাগুলো শুনুন, ‘আপনার বিপক্ষে ১০টি হার্ডল—সব দৌড়ই এমন। হ্যাঁ, পাশের জন তো চাপ তৈরি করবেই। তবে সামনের ব্যারিয়ারে (হার্ডল) যদি মনোযোগ না দেওয়ার সামর্থ্য থাকে, তাহলে এটা কোনো ব্যাপার নয়। তাই ওটাই ছিল আমার মনোযোগের জায়গা। যতটা সম্ভব দক্ষতায় ১০টি হার্ডল পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং প্রতিবারই টাইমিং কমানোর চেষ্টা করি।’ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এটা ‘পারফেক্ট রেস’ ছিল কি না? ম্যাকলাফলিন–লেভরোন দার্শনিকসুলভ উত্তরে নিজের পরের লক্ষ্যটাও জানিয়ে দিয়েছেন, ‘সব সময়ই উন্নতির জায়গা থাকে। পারফেক্ট রেস বলে কিছু নেই। তবে ধীরে ধীরে ৪৯ সেকেন্ডে নামিয়ে আনা সম্ভব। আমরা ইঞ্চি ইঞ্চি করে সেদিকে এগোচ্ছি। পায়ের সামর্থ্যটা তৈরি করে সেখানে পৌঁছাতে হবে।’

দৌড়কে অংকের মতো করে বুঝে নেন ম্যাকলাফলিন–লেভরোন

জয়ের পর জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে দর্শক অভিবাদনের জবাব দেন ম্যাকলাফলিন–লেভরোন। পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে পান মুকুটও। যেটিকে দারুণ উপযুক্তই বলতে হবে! ম্যাকলাফলিন–লেভরোন যে ২০২১ সাল থেকে এ নিয়ে ছয়বার বিশ্ব রেকর্ড ভাঙলেন। ট্র্যাকের প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে একই ইভেন্টে চারবার বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার কীর্তিও তাঁর। সেটাও মাত্র ১৩ মাসের ব্যবধানে! ৪০০ মিটার হার্ডলসে প্রথম নারী অ্যাথলেট হিসেবে ৫২ সেকেন্ড ও ৫১ সেকেন্ডের কমেও তিনিই প্রথম দৌড়েছেন। এমন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে প্রথম জয়ের খোঁজে তুমুল চেষ্টা করেও পারেননি বোল। ব্রোঞ্জ জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তিনবারের মিটে ম্যাকলাফলিন–লেভরোনের সঙ্গে প্রতিবারই হারলেন বোল।

নিজের ২৫তম জন্মদিনের পরদিন ট্র্যাকে ইতিহাস গড়ার আনন্দে ম্যাকলাফলিন–লেভরোন বলেছেন, ‘এই সুযোগের জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। ২৫তম জন্মদিনটা এভাবে উদ্‌যাপন করতে পারছি, সে জন্যও কৃতজ্ঞতা।’

ম্যাকলাফলিন–লেভরোনের রক্তেই মিশে আছে দৌড় প্রতিযোগিতা। তাঁর বাবা উইল ম্যাকলাফলিনও ৪০০ মিটার হার্ডলসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রাইডার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল অব ফেমেও তাঁর নাম আছে। আর মা মেরি ম্যাকলাফলিনও ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অ্যাথলেট ছিলেন। কার্ডিনাল ও’হারা হাইস্কুলে থাকতে দৌড়েছেন। মেয়ের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে উইল একবার বলেছিলেন, তাঁর মেয়ের সাফল্য পাওয়া ‘শুধুই সময়ের ব্যাপার’।

১৭ বছর বয়সে রিও অলিম্পিকে সাফল্যের খোঁজে সেই যাত্রা শুরু করেছিলেন ম্যাকলাফলিন–লেভরোন। এক দশকের কম সময়ের মধ্যে সেই ম্যাকলাফলিন–লেভরোন এখন দুবারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। শুধু কি তা–ই, মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলসে দ্রুততম ১০টি টাইমিংয়ের ৭টিই তাঁর! কীভাবে সম্ভব এমন পারফরম্যান্স? যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনবিসি ব্যাখ্যা দিয়েছে এভাবে। দৌড়কে গণিতের মতো বুঝে নেন ম্যাকলাফলিন–লেভরোন। ১০টি হার্ডলসের মধ্যে প্রথম সাতটি হার্ডলের মাঝে ১৪টি করে ধাপ ফেলেন তিনি। পরের তিনটি হার্ডলে ফেলেন ১৫টি করে ধাপ। তা, প্যারিসে জয়ের পর ম্যাকলাফলিন–লেভরোনের পরের ধাপ হবে কোথায়?

ম্যাকলাফলিন–লেভরোনের মুখে সোনা জয়ের হাসি

যেখানে তিনি বসবাস করেন এবং অনুশীলন করেন সেখানে—লস অ্যাঞ্জেলেস। ২০২৮ অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে সেখানে। ম্যাকলাফলিন–লেভরোন সেখানে টানা তৃতীয় সোনা জিততে চান। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সেই লক্ষ্যের কথা। ট্র্যাকে দৌড়ানোর পাশাপাশি এক চাকার সাইকেল চালাতে চালাতে যেকোনো কিছু ‘জাগলিং’ করতে ওস্তাদ মেয়েটি অবশ্য নিজের বয়সের কথাও মাথায় রাখছেন, ‘একেকটি বছর পেরোনোর সঙ্গে কাজটাও কঠিন হয়ে ওঠে...ট্র্যাক তো আর সারা জীবন থাকবে না। তাই আমি উপভোগ করে যেতে চাই। কোনো কিছুই আমি অবধারিত ধরে নিয়ে এগোই না।’