গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বারডেম হাসপাতালে। চিকিৎসক গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে কিছুই বলতে পারছিলেন না রাজীব। শুধু বলছিলেন, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কিছু বলতে পারছি না।’
জাতীয় দাবায় আজ বিকেলে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর ম্যাচ ছিল। বেলা সাড়ে ৩টায় শুরু হয়েছিল ম্যাচটা। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে একপ্রকার খেলতে খেলতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন জিয়া। খেলা চলাকালেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সতীর্থ গ্র্যান্ডমাস্টারের মৃত্যুটা চোখের সামনেই দেখেছেন। রাজীবের দুঃখ, ‘জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে কেন যেন কাল কোনো কথাই হলো না আমার।’
খেলা শুরুর আগে সাধারণত দাবার প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। কিন্তু আজ জিয়াউর রহমান নাকি বেশ গম্ভীর ছিলেন, ‘জিয়া ভাই খেলা শুরুর আগে হাত মেলালেন, এরপরই খেলা শুরু হয়ে যায়। আমরা খেলায় মন দিই। আড়াই ঘণ্টা চলার পর হঠাৎ খেয়াল করি, জিয়া ভাই একটু নিচু হয়ে গেছেন। কী হয়েছে, দেখার জন্য আমি চেয়ার থেকে উঠতেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অবিশ্বাস্য লাগছে। আমাকে খুব স্নেহ করতেন তিনি। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার সময় তাঁর অনেক সহযোগিতা পেয়েছিলাম। গত বছর হাংজু এশিয়ান গেমসেও একসঙ্গে গিয়েছিলাম। তিনি আমার রুমমেট ছিলেন। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি।’
বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। সেটি ১৯৮৭ সালে। দ্বিতীয় দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার হন জিয়াউর রহমান, ২০০২ সালে। এরপর একে একে এসেছেন রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব। স্নেহের জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সংবাদ হতবাক করে দিয়েছে নিয়াজ মোরশেদকে। আজ মৃত্যুর খবর পেয়েই তিনি এসেছিলেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে, অঝোরে কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বললেন, ‘আমার খুব স্নেহের এক ছোট ভাইকে হারালাম। জিয়ার মৃত্যু এ দেশের দাবারই শুধু নয়, ক্রীড়াঙ্গনেরই বিরাট ক্ষতি। বড় অসময়ে চলে গেল জিয়া।’
জিয়াউর রহমানের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে এসেছিলেন দাবাড়ু তনিমা আহমেদ। তিনিও কাঁদছিলেন। কাঁদছিলেন আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমান। ফাহাদ বিশ্বাসই করতে পারছেন না মানুষটা নেই, ‘জিয়া ভাইকে দেখে বড় হয়েছি। ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। মানুষটা নেই, ভাবতেই পারছি না।’
দেশের আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার জিয়াউর রহমানের সমবয়সী। দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। ২০০৭ সালে দেশের তৃতীয় দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন রিফাত। আজই দেশের বাইরে থেকে ফিরেছেন। ফিরেই এক বন্ধুর ফোন পেলেন—জিয়া নেই!
‘খবরটা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। আমরা সব সময়ই দারুণ বন্ধু ছিলাম। আমরা সমবয়সীও। একই সঙ্গে দাবা শুরু করেছি। সব সময়ই যোগাযোগ ছিল। সারাক্ষণ দাবা নিয়ে ভাবত। জিয়া ইচ্ছা করলে দাবার বাইরে অনেক কিছুই করতে পারত। ভালো চাকরি করতে পারত। কিন্তু সেসব না করে ও দাবাই খেলে গেছে। দাবাকে ভালোবেসে দাবার বোর্ডেই সে চলে গেল। এর চেয়ে গৌরবজনক মৃত্যু আর কী হতে পারে’—কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বললেন রিফাত।
আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিলের কাল ম্যাচ ছিল জিয়াউর রহমানের পাশের টেবিলেই। খেলা ছিল জিয়ার সন্তান ফিদে মাস্টার তাহসিন তাজওয়ারের সঙ্গেই। শাকিলের পুরো ব্যাপারটাই দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে, ‘সুস্থ একটা মানুষ দাবা ফেডারেশনে এলেন। খেলা শুরু করলেন। সেই মানুষটাই ঘণ্টা দুয়েক পর নেই। বিশ্বাসই হচ্ছে না। পাশের টেবিলেই আমি খেলছিলাম। আমার খেলা ছিল জিয়া ভাইয়ের ছেলে তাহসিনের সঙ্গেই।’
আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব দাবায় নেই ২০২১ সাল থেকে। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হয়, তিনি পথে। মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটিতে জিয়াউর রহমানের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। মুঠোফোনে বললেন, ‘জিয়া ভাই মানুষ হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। সারাক্ষণ দাবা নিয়েই ভাবতেন। তাঁর মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি আর একজন জিয়াউর রহমান আমরা পাব কি না, সন্দেহ।’ দাবার সবার কণ্ঠেই স্বজন হারানোর কান্না।