দুই দাবাড়ু বোন ওয়ালিজা আহমেদ ও ওয়াদিফা আহমেদে
দুই দাবাড়ু বোন ওয়ালিজা আহমেদ ও ওয়াদিফা আহমেদে

জিয়াবিহীন শূন্যতার মধ্যেই এই প্রথম অলিম্পিয়াডে যাচ্ছেন দুই বোন

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১১ সেপ্টেম্বর শুরু ৪৫তম বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াড সামনে রেখে আগামীকাল ঢাকা ছাড়ছে বাংলাদেশ দল। এ উপলক্ষে আজ বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের ক্রীড়াকক্ষে হয়ে যাওয়া অলিম্পিয়াডগামী দলের সংবাদ সম্মেলনে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানকে ছাড়াই যাওয়ার শূন্যতার হাহাকার ভেসে বেড়াল। অন্যদিকে এই প্রথম অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে দুই বোন ওয়ালিজা আহমেদ ও ওয়াদিফা আহমেদের একসঙ্গে খেলতে যাওয়ার উচ্ছ্বাসও থাকল।

১৯৮৪ থেকে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১৯ বারের মধ্যে ১৬ বারই দলে ছিলেন জিয়া। ১৯৮৮ সাল থেকে তাঁর যাওয়া শুরু। মাঝে দাবা ফেডারেশনের সঙ্গে দূরত্বের কারণে ২০১০ সালে নিজেই যাননি। ২০২০ সালে অলিম্পিয়াড হয়নি করোনার কারণে। ২০২২ সালে সর্বশেষ চেন্নাই দাবা অলিম্পিয়াডে জিয়া গিয়েছিলেন ছেলে তাহসিন তাজওয়ারকে নিয়ে। বাবা-ছেলের অলিম্পিয়াডে খেলার সেটি ছিল একটা রেকর্ড। এবার তাহসিন যাচ্ছেন, কিন্তু জিয়া নেই। গত ৫ জুলাই জাতীয় দাবায় খেলতে খেলতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন জিয়া।

জিয়ার পুত্র তাহসিনের সঙ্গে বুদাপেস্ট যাচ্ছেন তাঁর মা তাসমিন সুলতানা। সংবাদ সম্মেলনকক্ষে তাসমিনও ছিলেন। জিয়ার অনুপস্থিতি তাঁকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। বললেন, ‘ভাবতেই পারছি না জিয়া নেই। এখনো মনে হয় ও আমাদের সঙ্গেই আছে। গত অলিম্পিয়াডেও আমরা তিনজন একসঙ্গে গিয়েছিলাম। এবার দুজন যাচ্ছি, একজন নেই।’

ছেলে ফিদে মাস্টার তাহসিনের মনেও বাবাকে ছাড়া যাওয়ার হাহাকার, ‘বাবা নেই, এখনো মানতে পারছি না। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমি যেন এবারের অলিম্পিয়াডে যেতে পারি। আমি ঠিকই যাচ্ছি কিন্তু বাবা নেই। তাঁর স্বপ্ন ছিল আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হব। বাবার স্বপ্নপূরণের চেষ্টা করছি। অলিম্পিয়াডে ভালো খেলে নর্ম করতে চাই।’

ছেলে তাহসিনের সঙ্গে বিশ্ব অলিম্পিয়াডে যাচ্ছেন মা তাসমিন সুলতানা

বাংলাদেশের এবারের ওপেন ও নারী দুটি দলই তারুণ্যনির্ভর। এই প্রথম অলিম্পিয়াডগামী বাংলাদেশ দলের দাবাড়ুদের গড় বয়স সবচেয়ে কম। তারুণ্যনির্ভর দল যাওয়া যেমন আনন্দের, তেমনি জিয়া না থাকায় বাংলাদেশের শক্তি হারানোও চিন্তার কারণ। জিয়া এক নম্বর বোর্ডে খেলতেন। তাঁকে না পাওয়া দলের জন্য বিশাল ক্ষতি বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিচারক হয়ে অলিম্পিয়াডে যাওয়া হারুন অর রশিদ, ‘তরুণ একটা দল নিয়ে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু জিয়া থাকলে আরেকটু ভালো হতো। অভিজ্ঞতার একটা আলাদা মূল্য আছে।’

এবার বাংলাদেশের প্রথম বোর্ডে রাখা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমানকে। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মনন রেজা দ্বিতীয় বোর্ড, গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব তৃতীয় বোর্ডে। চতুর্থ বোর্ড নিয়াজ মোরশেদ। তাঁদের কেউ একটু একটু খারাপ বা শরীর খারাপ হলে তাহসিন চলে আসবেন বোর্ডে।

বাংলাদেশ দলের প্রস্তুতি খুব একটা ভালো হয়নি। ছিল না কোনো কোচ। গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব নারী দলকে অনুশীলন করিয়েছেন। এ জন্য দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম রাজীবকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘একজন গ্র্যান্ডমাস্টার যে পরিমাণ সম্মানী নিয়ে একটি সেশন করে, এর চেয়ে অনেক কমে রাজীব আমাদের নারীদের ট্রেনিং দিয়েছে। দেশের চলমান পরিস্থিতি ও সামগ্রিক পটভূমি মিলিয়ে আমরা এরপরও আশা করছি সন্তোষজনক ফলাফল হওয়ার।’

সন্তোষজনক বলতে ওপেন বাংলাদেশের লক্ষ্য প্রথম ৫০-এর মধ্যে থাকা। গতবার ওপেনে বিভাগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৪তম। নারী বিভাগে ৬২তম হয়েছিল বাংলাদেশ। নারী বিভাগের লক্ষ্য নিয়ে রাজীব বলেছেন, ‘গতবার আমরা নারী বিভাগে বি ক্যাটাগরিতে রানার্সআপ হয়েছিলাম। এবার আমরা চাইব চ্যাম্পিয়ন হতে।’

নারী দলে আছেন বর্ষীয়ান রানী হামিদ। ১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়া রানী হামিদ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ৮১ বছরে পা দিয়েছেন। কিন্তু বয়সের কাছে হার মানেনি। গত অলিম্পিয়াডে দলে জায়গা পাননি। এ ছাড়া বাকি সব অলিম্পিয়াডেই খেলেছেন। দলে ফিরে আসতে পেরে খুব খুশি তিনি। এ সুযোগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসবেন বলেছেন প্রথম আলোকে, ‘জিয়ার মৃত্যু ভীষণ নাড়া দিয়েছে আমাকে। ফলে সারাক্ষণ বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত লাগে। বিশ্বদাবার অনেকে আমার বন্ধু। অনেকে চেনে। ফলে সবার কাছ থেকে এবার বিদায় নিয়ে আসব। আবার যেতে পারব কি না, সেটা তো জানি না।’

বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডগামী দলের সংবাদ সম্মেলনে ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দাবাড়ুরা

রানী হামিদ ছাড়া বাংলাদেশ নারী দলের বাকি চারজনই তরুণী। দাবা ফেডারেশন বলছে, বাংলাদেশের হয়ে বোর্ডে রানীর খেলার সম্ভাবনা কম। তরুণ চারজনেরই বোর্ডে খেলার কথা। দুই বোনের মধ্যে বড়জন ওয়ালিজা আহমেদ গতবার অলিম্পিয়াডে কোয়ালিফাই করলেও পরীক্ষার কারণে যেতে পারেননি। এবার যেতে পেরে তাঁর উচ্ছ্বাস, ‘আগামীকাল রওনা হচ্ছি বোনকে সঙ্গে নিয়ে। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই আমার কাছে।’

ওয়াদিফা বললেন,‌ ‘দুই বোন একসঙ্গে অলিম্পিয়াড খেলব, এটা অনেক বড় আনন্দের।’ নারী দলে বাকি দুজন নোশিন আনজুম ও নুশরাত জাহান।

অলিম্পিয়াড শেষে মনন রেজা, ফাহাদ রহমান, তাহসিন তাজওয়ার, ওয়াদিফা ও ওয়ালিজা বুদাপেস্টে আরও দুটি টুর্নামেন্ট খেলবেন নর্মের আশায়।