ইউরোপের কোনো দেশে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী দাবা দলের প্রথম সফরের গল্প
জীবনের পরতে পরতে নানা সংকটে তাঁরা। কেউ চোখে দেখেন না। কারও শ্রবণশক্তি কমে গেছে। চলাচলের শক্তি হারিয়ে কারও কাছে জীবনটা হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। এই জীবনে এক টুকরা স্বস্তি পাওয়ার সুযোগে তাঁরা চারজন উড়ে গিয়েছিলেন সার্বিয়ার বেলগ্রেডে। যেখানে গত ২৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হয়েছে প্রতিবন্ধীদের প্রথম দাবা—‘অলিম্পিয়াড ফর পিপল উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ’।
ফুটবল–ক্রিকেটে যেমন বিশ্বকাপ, দাবায় তেমনি অলিম্পিয়াড। শারীরিকভাবে বিশেষ দাবাড়ুদের অলিম্পিয়াড এর আগে অনলাইনে হলেও এই প্রথম হয়েছে সশরীর। সার্বিয়ার ২টিসহ ২৪ দেশের ২৬টি দল খেলেছে ৬ রাউন্ড সুইস লিগ পদ্ধতিতে। প্রতি দলে একজন দৃষ্টিহীন, একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ও একজন বধির ব্যক্তির খেলতে পারার নিয়ম ছিল। কোনো দল চাইলে চারজন বধির ব্যক্তিকেও খেলাতে পেরেছে। বাংলাদেশের চার খেলোয়াড়ের দুজন দৃষ্টিহীন, একজন করে বধির ও শারীরিক প্রতিবন্ধী।
এই খেলোয়াড়দের মধ্যে ৬২ বছরের শারীরিক প্রতিবন্ধী খোরশেদ আলমের ফিদে রেটিং ২০২৬। বাংলাদেশে সক্রিয় পুরুষ দাবাড়ুদের তালিকায় তিনিই সবচেয়ে বয়সী। পুরোপুরি দৃষ্টিহীন সৈয়দ এজাজ হোসেন (১৯৫২) তাঁর ভুবনে পরিচিত নাম। ঝাপসা হলেও চোখে কিছুটা দেখেন ৩১ বছরের বাপ্পী সরকার (১৭৭৮), তবে পড়তে পারেন না। শ্রবণশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলা ৩৮ বছরের আলী নেওয়াজ সরকারের রেটিং ১৮০৯।
বিশ্ব দাবা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ দল ২৮ জানুয়ারি বেলগ্রেড গিয়েছিল। সেটিই ইউরোপের কোনো দেশে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী দাবা দলের প্রথম সফর। বেলগ্রেডের নামী পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজকেরা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, খেলাও হয়েছে ওই হোটেলে। র্যাঙ্কিংয়ে ১৬ নম্বরে থাকা বাংলাদেশ এই টুর্নামেন্টে হয়েছে ১৩তম। ৬ ম্যাচে ৩ হারের পাশে ৩ জয়কেই বড় করে দেখছেন দাবাড়ুরা। সঙ্গে আছে চেক রিপাবলিকের মতো দলকে হারানোর তৃপ্তি। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পোল্যান্ড।
খেলার বাইরে ঘোরার সময় ছিল না দাবাড়ুদের। তার ওপর তীব্র ঠান্ডা, বিমানবন্দরে নেমেই ঠান্ডায় সবার নাকি খারাপ অবস্থা। হোটেলে শুধু একবার সুইমিংপুলে ঢুঁ মেরেছেন তাঁরা। দৃষ্টিহীন এজাজ ও বাপ্পি সিঁড়ি বেয়ে পুলে গিয়ে পানিতে একটু পা ছোঁয়ান। সাঁতার পারেন না বলে তাঁরা নামেননি পানিতে। তবে আলী নেওয়াজ পুলে নামেন।
আলী নেওয়াজ ও বাপ্পি সরকার হোটেলের বাইরে একবার একটু গিয়েছিলেন রোদ পোহাতে। তাঁরা দুজন সবার জন্য চকলেটও কিনে আনেন। আলী নেওয়াজের কাছে স্মৃতিটা মধুরই, ‘জীবনে কখনো এই সফর ভুলব না।’ দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য খোরশেদ আলমের ভালো লেগেছে গোটা আয়োজনটাই, ‘প্রতিদিনই সার্বিয়ার কোনো মন্ত্রী এসে উদ্বোধন করতেন দিনের খেলা। এটা ছিল দারুণ ব্যাপার।’
এটা ছিল আসলে প্রতিবন্ধী দাবাড়ুদের বৈশ্বিক মিলনমেলা। বাংলাদেশ দলের নন-প্লেয়িং অধিনায়ক ও বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদুর রহমান মল্লিক সেটাই বলছিলেন দেশে ফিরে, ‘এই মানুষগুলোর জন্য ইউরোপের ভিন্ন পরিবেশে, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া বিরাট ব্যাপার। যার মধ্যে ফিদের সভাপতির সঙ্গের ওদের পরিচয় করিয়ে দিই। কটা দিন ওদের দেখাশোনা করতে আমার কিছুটা কষ্ট হলেও খুশি হয়েছি ওদের জন্য কিছু করতে পেরে।’
প্রায় ১৩০ দাবাড়ুর মহামিলনে ভারতের একজন ও বাংলাদেশের এজাজ পুরোপুরি দৃষ্টশক্তিহীন। এজাজকে নিয়ে কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর খেলার পাতায় ছাপা হওয়া এক লেখার শিরোনাম ছিল ‘নেভেনি তার মনের আলো’। সত্যিই নেভেনি।
৩৮ বছরে বয়সেও ইজাজ ২০ বছরের তরুণের মতো চনমনে। বাংলাদেশে দৃষ্টিহীন দাবাড়ুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তিনিই সবচেয়ে এগিয়ে। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র এজাজ ইংরেজিতে স্নাতক শেষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ পর্যায়ে আছেন। এখন অনলাইনে দাবা শেখান।
কঠিন সংগ্রামের এই জীবনে বেলগ্রেড সফরটা ভুলবেন না এজাজ, ‘একটা ব্রিটিশ দাবা ম্যাগাজিন সেখানে আমার সাক্ষাৎকার নেয়। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কাছে দাবা মানে কী?” আমি বললাম, “দাবা মানে আমার বেঁচে থাকার বড় অবলম্বন। দাবা ছাড়া আমার জীবন আরও মরুভূমি হয়ে উঠবে!” ওদের বলেছি, “দেখুন, আমার ২০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে। জীবনে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হতে চেয়েছিলাম আর দাবা খেলতে চেয়েছিলাম। প্রথমটা সম্ভব হলো না প্রতিবন্ধিতার কারণে। তবে আমি সারা জীবন দাবাই খেলতে চাই। বেলগ্রেড আমাকে নতুন প্রেরণা দিয়েছে।”’
বেলগ্রেডের স্মৃতি নিয়ে আপ্লুত বাপ্পিও, ‘বাংলাদেশর অন্য প্রতিবন্ধী দাবাড়ুরা এতে উজ্জীবিত হবে। বেলগ্রেডে দেখেছি, প্রতিবন্ধীদের অন্য অনেক সুযোগ–সুবিধা বেশি। আমাদের জন্য যা শিক্ষণীয় হতে পারে।’
বাপ্পির শেষ কথাটাই আসল কথা।