মাঠে খেলা নেই, এভাবেই খালি পড়ে থাকে মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের টার্ফ
মাঠে খেলা নেই, এভাবেই খালি পড়ে থাকে মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের টার্ফ

পাঁচ বছরে মাত্র একটি লিগ, হকি ফেডারেশন কী করছে

সর্বশেষ ৫ বছরে প্রিমিয়ার হকি লিগ হয়েছে মাত্র একবার! ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বরে সর্বশেষ লিগ শেষ হওয়ার পর দুই বছর পেরিয়ে গেছে, লিগের কোনো খবর নেই।

বাংলাদেশের খেলাধুলার জগতে সব খেলার উপস্থিতিই কমবেশি আছে। শীর্ষ স্তরের ক্রিকেটার-ফুটবলাররা সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন মাঠে। কিন্তু তৃতীয় প্রধান খেলা হকি যেন ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে! বাংলাদেশে এই একটি খেলার ঘরোয়া আয়োজন সবচেয়ে অনিয়মিত। এর কোনো বর্ষপঞ্জি নেই। কবে কোন খেলা, কেউ বলতে পারেন না। ক্লাবগুলো খেলতে চাইলে তবেই খেলা হয়। নইলে খেলা হয় না।

২০১৯ থেকে ধরলে ৫ বছরে প্রিমিয়ার হকি লিগ হয়েছে মাত্র একবার! ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বরে সর্বশেষ লিগ শেষ হওয়ার পর দুই বছর পেরিয়ে গেছে, লিগের কোনো খবর নেই। একটা লিগ শেষ করার তৃপ্তিতেই পরের ১২-১৪ মাস হেলেদুলে কেটে যায় কর্মকর্তাদের। এতে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের হকি কর্মকর্তাদের কাজ আসলে কী? ফেডারেশনে গিয়ে চা-নাশতা খাওয়া আর বিদেশভ্রমণে যাওয়া? অবস্থাদৃষ্টে কিন্তু তা–ই মনে হচ্ছে।

হকির চাকা ঘোরে না

ঘরোয়া হকির খতিয়ান বই খুলে বসলে ছন্নছাড়া অবস্থাই বেরিয়ে আসে। ১৯৯৮ থেকে ২৫ বছরে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হয়েছে মাত্র ১৩ বার। ২০০২ থেকে ২০০৪ টানা তিন বছর বাদ দিলে আর কখনো টানা দুই বছর প্রিমিয়ার লিগ হওয়ার নজির নেই। ২০০৬, ২০০৮, ২০১০, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৮ সালের লিগ এক বছর পরপর হওয়ার অলিখিত রীতি ধরে রাখে। ২০১৮ সালের পর হকি লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তিন বছরেরও বিরতি পড়ে।

সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে মেরিনার্সের উল্লাস। লিগ নিয়মিত না হওয়ায় এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না হকিতে।

প্রিমিয়ার লিগ না হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথম, দ্বিতীয় বিভাগও হয় না। প্রিমিয়ার লিগের মতোই তাই অবস্থা এ দুটি লিগের। ১৯৯৮ থেকে গত ২৫ বছরে প্রথম বিভাগ লিগ হয়েছে ১২ বার। ২০১২ থেকে দ্বিতীয় বিভাগ লিগ হয়েছে মাত্র ৫ বার। বিজয় দিবস টুর্নামেন্ট সর্বশেষ হয়েছে ২০২০ সালে। শহীদ স্মৃতি হয়েছে ২০২১ সালে। অনেক টালবাহানা শেষে চার বছর পর চলতি বছরে ২০২১ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ লিগ হয়েছে। এ দুটি আসর ছাড়া ২০২৩ সালে ঘরোয়া হকিতে আর কিছু হয়নি।

সমস্যা কোথায়

চলতি বছর প্রিমিয়ার লিগ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়ে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সভায় বসে ফেডারেশনের লিগ কমিটি। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদের ভাষ্য, সভায় প্রিমিয়ারের ১২টি ক্লাবের ১০টি (আবাহনী, মোহামেডান, মেরিনার্স, সোনালী ব্যাংক, অ্যাজাক্স, ওয়ারী, দিলকুশা, ভিক্টোরিয়া, বাংলাদেশ পুলিশ ও সাধারণ বীমা) জাতীয় নির্বাচনের আগে দলবদলে রাজি হয়। পুরান ঢাকার দুই ক্লাব প্রিমিয়ার লিগে সাবেক চ্যাম্পিয়ন ঊষা ক্রীড়া চক্র ও বাংলাদেশ স্পোর্টিং দলবদল চায়নি এখন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতিতে দলবদলের খসড়া তারিখ ঠিক হয় ২৫ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে।

এ বছর প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার হকিতে ফিরেছে ঊষা। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগই তো হচ্ছে না।

কিন্তু ৮ নভেম্বর বিমানবাহিনীর ফ্যালকন হলে হকি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সভায় দলবদলের আলোচনা ধামাচাপা পড়ে যায়। জানা গেছে, সভায় ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ফুটবল, ক্রিকেটের উদাহরণ টেনে ‘হকি কেন হবে না’ প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, যাঁরা হকির ক্লাব কর্মকর্তা, তাঁরাই আবার ফেডারেশনেরও কর্মকর্তা। ফেডারেশনের সভায় বসে তাঁরাই নানা সমস্যার কথা বলেন।

ঊষার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ ফেডারেশনের সহসভাপতি হিসেবে সভায় জাতীয় নির্বাচনের আগে দলবদলের বিরোধিতা করে আর্থিকসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। অথচ ঊষা প্রিমিয়ার লিগের একমাত্র ক্লাব, যারা শুধু হকিই খেলে। অন্য ক্লাব প্রতিনিধিরা নাকি দলবদলের আলোচনায় মৌনই ছিলেন। এ নিয়ে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নিজের অসহায়ত্বের কথাই বলছেন, ‘তারা যখন চুপ থাকে, তাদের অনিচ্ছাটা বোঝা যায়। আমাদের কর্মকর্তারাই যখন দলবদলের ব্যাপারে আমার প্রস্তাবকে সমর্থন করে কথা বলেননি, তখন আর কী করার থাকে! শুরুতেই যে প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়, সেটা নিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। আমি বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে কথা বলে ব্যক্তিগতভাবে কিছু সমস্যার সমাধান করে হলেও তাদের রাজি করিয়েছিলাম দলবদলে যেতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম না। এই ব্যর্থতা আমার।’

ক্লাব কেন খেলতে চায় না

বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। তারা চলে পৃষ্ঠপোষকের টাকায়। এখানেই হকির দুর্ভাগ্য। পৃষ্ঠপোষকের টাকায় একটা ক্লাব ক্রিকেট-ফুটবল নিয়মিত খেলতে পারলেও হকির বেলায় রাজ্যের ওজর-আপত্তি। অবশ্য এটা নতুন কিছুও নয়। ক্লাবের কাছে ফেডারেশন অনেক আগে থেকেই জিম্মি। ক্লাবগুলো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারে না বেশির ভাগ সময়। ফেডারেশনে পছন্দের সাধারণ সম্পাদক না থাকলে অসহযোগিতা চলে। কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি তো আছেই।

নির্বাচনের আগে দলবদলে অনীহা কেন ছিল, এর ব্যাখ্যা চাইতে ফোন করা হলে ঊষার কর্মকর্তা আবদুর রশিদ ফোন ধরেননি। তবে বাংলাদেশ স্পোর্টিংয়ের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমাদের আর্থিক সমস্যা আছে। তবে নির্বাচনের পর আমরা অবশ্যই খেলব।’

ফেডারেশনে পক্ষ থেকে আমাদের চিন্তা ছিল এশিয়ান গেমসের আগে দলবদল দিয়ে গেমসের পর লিগ শুরু করতে। কিন্তু কিছু ক্লাবের অনীহার কারণে সেটা হয়নি। তারা বলেছে, নির্বাচনের আগে ডোনাররা টাকা দেবে না। তবু ক্লাবগুলো আরেকটু চেষ্টা করলে লিগটা এখনই হতো বলে আমার বিশ্বাস। না হওয়ায় আমি মর্মাহত
মাহবুবুল এহছান, হকি ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক

আবাহনীর যুগ্ম সম্পাদক সাবেক খেলোয়াড় মাহবুবুল এহছান আবার ফেডারেশনেরও যুগ্ম সম্পাদক। আবাহনীর কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় খেলতে রাজি। কাল দলবদল দিলেও রাজি।’ তাহলে দলবদল কেন হলো না? মাহবুব এহছান বলেন, ‘ফেডারেশনের কর্মকর্তা হিসেবে বলব, ফেডারেশনে পক্ষ থেকে আমাদের চিন্তা ছিল এশিয়ান গেমসের আগে দলবদল দিয়ে গেমসের পর লিগ শুরু করতে। কিন্তু কিছু ক্লাবের অনীহার কারণে সেটা হয়নি। তারা বলেছে, নির্বাচনের আগে ডোনাররা টাকা দেবে না। তবু ক্লাবগুলো আরেকটু চেষ্টা করলে লিগটা এখনই হতো বলে আমার বিশ্বাস। না হওয়ায় আমি মর্মাহত। খেলোয়াড়দের কাছে লজ্জিতও।’

খেলোয়াড়েরা হতাশ

শীর্ষ স্তরের ২৫-৩০ জন হকি খেলোয়াড় বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি করেন। নৌবাহিনীতেই আছেন ১৩-১৪ জন। তাঁদের চলতে হয়তো সমস্যা হয় না। কিন্তু বিরাটসংখ্যক হকি খেলোয়াড়ের রুটিরুজি বন্ধ। জাতীয় দলের স্ট্রাইকার পুষ্কর খীসা রাঙামাটির বাড়ি থেকে ফোনে বললেন, ‘লিগ না হওয়া হকির জন্য অনেক খারাপ। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ক্রিকেট, ফুটবল চলছে। শুধু হকিই হয় না। না পারছি খেলা ছাড়তে, না পারছি খেলতে। এভাবে বসে থাকা অনেক কষ্টের।’

খেলা নেই, তাই হকি খেলোয়াড়েরাও পড়েছেন নানা সংকটে।

জাতীয় দলের আরেক খেলোয়াড় আশরাফুল ইসলামের দীর্ঘশ্বাস, ‘এখন জিনিসপত্রের যা দাম, কীভাবে হকি খেলোয়াড়েরা চলবে বলেন! মাত্র ৩০ জন খেলোয়াড় ভালো থাকলে তো হবে না। বাকি ১০০ জন কী খাবে? হকির খবর কী, এটা যখন বাসায় জানতে চায়, নিজেকে ছোট মনে হয়।’ খোরশেদুর রহমানের আক্ষেপ, ‘বাহিনীগুলো সহায়তা না করলে হকি খেলোয়াড়েরা না খেয়ে মরত। আমাদের খেলা হলো কি হলো না, কাকপক্ষীও খবর নেয় না।’

হকি খেলোয়াড়দের এই আক্ষেপ, এই হতাশা কবে যে দূর হবে!