ঘরোয়া হকি মানেই যেন মারামারি আর বিশৃঙ্খলা। যেমনটা হলো গত পরশু আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচেও।
হকি মাঠের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ৩০ বছরের বেশি সময়ের। নিজে খেলেছি, তারপর সংগঠক হয়েছি। এবার ঊষা ক্রীড়া চক্রের কর্মকর্তা হিসেবে মাঠে ছিলাম। সব সময়ই দেখেছি, বড় ম্যাচগুলোয় নানা ছুতায় গোলমাল লেগেই থাকে। কখনো গোল নিয়ে, কখনো অন্য কিছু। পরশু মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডান অঘোষিত ফাইনালও এর ব্যতিক্রম নয়। মোহামেডান খেলতে অস্বীকৃতি জানানোয় ম্যাচের শেষ ১৭ মিনিট হয়নি, অতীতেও এমন হয়েছে। ঘরোয়া হকিকে আসলে আমরা কখনোই ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এটা বড়ই দুর্ভাগ্যের। সমস্যা হলো, আমরা হার মানতে পারি না।
সেই আগের মনমানসিকতা নিয়েই আছি আমরা। সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধে গেলেই মেনে নিতে পারে না কেউ। বিশেষ করে ক্লাবগুলোর কথা বলব। ক্লাবগুলো নানা অজুহাতে ঝামেলায় জড়ায়।
লিগটা নিয়মিত হয় না, হলেও নানা সমস্যা লেগেই থাকে। এই যে মোহামেডান খেলল না, এমন মানসিকতার বদল না হলে হকির উন্নতি হবে না কখনোই। হাস্যকর শোনালেও বলব, ফেডারেশনের উচিত সব ক্লাব থেকে বন্ড বা মুচলেকা নেওয়া, যাতে মাঠে গোলমাল না করে।রফিকুল ইসলাম কামাল
ফেডারেশনের উচিত, লিগ শুরুর আগে লিগের বাইলজটা সবাইকে পড়ানো। সব টিম বাইলজ পড়ে না। সব নিয়ম জানেও না। এর ফলে পদে পদে ঝামেলা তৈরি হয়। এবার এক ঘণ্টার ম্যাচ শেষ হতে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টাও লেগেছে। রেফারেল নিয়ে সময় নষ্ট হয়েছে। ম্যাচ শুরু হচ্ছে, কিন্তু শেষ কখন, কেউ বলতে পারেনি।
আমরা সব সময়ই বলি, হকি একটা সম্ভাবনার খেলা। একসময় দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা ছিল। এখন তৃতীয় জনপ্রিয়। আমাদের ঘরোয়া লিগটা নিয়মিত হয় না। আবার লিগ হলেও নানা সমস্যা লেগেই থাকে। এই যে মোহামেডান খেলল না, এমন মানসিকতার বদল না হলে হকির উন্নতি হবে না কখনোই। হাস্যকর শোনালেও বলব, ফেডারেশনের উচিত, সব ক্লাব থেকে বন্ড বা মুচলেকা নেওয়া, যাতে মাঠে গোলমাল না করে।
আবাহনী-মোহামেডান মহারণে দর্শক আসেন মাঠে। মিডিয়া কাভারেজও খুব ভালো ছিল। সুন্দরভাবে সবকিছু শেষ হলে হকির জন্যই ভালো হতো। কিন্ত তা হলো কই! ফেসবুক খুললে এখন শুধু হকি নিয়ে নেতিবাচক প্রচার। এটা হকির জন্য খুবই খারাপ দিক।
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে প্রথমে যে খেলোয়াড় এই ঝামেলা শুরু করে, আবাহনীর সেই মিমোকে কোনো কার্ড কিন্তু দেওয়া হয়নি। সিদ্ধান্তটা নিরপেক্ষ হতে হবে। কিন্তু যদি মনে হয়, সিদ্ধান্ত একটা দলের পক্ষে যাচ্ছে, তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে। টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের আরও সর্তক থাকা উচিত। ওমান ও শ্রীলঙ্কার দুজন বিদেশি আম্পায়ার ছিলেন মাঠে, তাঁদের আগেই সবকিছু বোঝানো দরকার ছিল। খেলাটা যাতে শেষ হয়, সিদ্ধান্তটা সেভাবেই নিলে ভালো হতো।
আম্পায়ার প্রথমেই ঝামেলাটা শেষ করতে পারতেন। মিমো এসে মোহামেডানের এক খেলোয়াড়কে ধাক্কা দেয়। পেছন থেকে মোহামেডানের রিপন এসে মিমোকে ধাক্কা মারে। ওখানে দুই দলের চারজন খেলোয়াড় ছিল। ওই সময় খেলাটা বন্ধ করে চারজনকে কার্ড দেখিয়ে দিলে ঝালেলাটা মিটে যেত। অথচ তখনই খেলাটা না থামানোয় মোহামেডানের বেঞ্চের খেলোয়াড়েরা যোগ দেয়, এমনকি আবাহনীরও দুই–একজন ছুটে আসে। এর ফলে একটা লঙ্কাকাণ্ড ঘটে।
মোহামেডানের অবশ্যই উচিত ছিল খেলাটা চালিয়ে নেওয়া। ৩-২ গোলে এগিয়ে তারা, জিতলেই তো চ্যাম্পিয়ন। মারামারিতে জড়ানোর দরকার ছিল না তাদের। কেন মোহামেডানের খেলোয়াড়েরা ডাগআউট থেকে মাঠে গেছে, কর্মকর্তারা কেন আটকাতে পারেননি? আটকাতে পারলে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না মোহামেডানকে। মোহামেডানের ভাবা উচিত ছিল, যখন জিততে চলেছে, দরকারে মার খাবে। যে অবস্থা ছিল, ম্যাচের গতিটা ধরে রাখতে পালে আরও দুই-তিন গোল করতে পারত মোহামেডান। কিন্তু তারা সেই সুযোগ নেয়নি। মোহামেডান ষড়যন্ত্রের কথা বলছে। আপনি খেলায় যখন পারবেন না, তখন এসব কথা আসে।
খুব শক্ত হাতে আম্পায়াররা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। ফেডারেশনেরও দায়িত্ব ছিল। তারা কথা বলে সমাধান করতে পারত। আম্পায়ার নির্বাচনে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ফেডারেশনের। এবার আনা আম্পায়ারদের খুব ভালো মানের মনে হয়নি আমার। তবে আমাদের লিগটা বেশ ভালো মানের। বিদেশিরা আগ্রহী এখানে খেলতে। পাকিস্তানের অনেক খেলোয়াড় আমাকে বলেছে, ‘শুধু প্লেনভাড়া দেন, আমরা খেলি, তারপর ম্যাচ ফি যা দেওয়ার দেবেন।’ লিগের বড় ম্যাচগুলোয় বেশ লড়াই হয়েছে। সোহানুর রহমান ৩৯ গোল করেছে। ২৯ বছর আগে আমি করেছিলাম সর্বোচ্চ ৪০ গোল। আমার রেকর্ডটা এখনো অক্ষুণ্ন আছে। ভালোই লাগছে। তবে হকির এই বিশৃঙ্খলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
লেখক: জাতীয় হকি দলের সাবেক স্ট্রাইকার