৫৬ বছর বয়সে পদক জিতলেন দিনাজপুরের স্কুলশিক্ষক

তায়কোয়ান্দোতে পদকজয়ী ৫৬ বছর বয়সী জাকির হোসেন।
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম দেখায় ভ্রম মনে হতে পারে। মাথায় পাকা চুল ও মুখে সাদা দাড়ি। কিন্তু পরনে সাদা খেলোয়াড়ি পোশাক ও কোমরে প্যাঁচানো কালো ফিতা। ঠিক দেখছি তো!

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেসিয়ামের যেদিকে তাকানো যায়, শুধু তরুণদের উচ্ছল মুখ। বাংলাদেশ গেমসের তায়কোয়ান্দোতে পদক জয়ের নেশায় বাতাসে পাঞ্চ ও কিক মেরে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছেন তাঁরা। সেই ভিড়ে ৫৬ বছর বয়সী জাকির হোসেনকে দেখলে ভুল না ভেবে উপায় কী! বয়সটা তাঁর মুখ থেকেই শুনি, ‘মূল বয়স ৫৬। সার্টিফিকেট অনুযায়ী ৫২।’

প্রথম দেখায় মনে হতে পারে শুধু মনের জোরেই দিনাজপুর থেকে ঢাকায় চলে এসেছেন। কিন্তু না, হাতে–পায়ে জোরও আছে। জিতেছেন পুরস্কারও। পুমসে সিনিয়র পুরুষের ঊর্ধ্ব–৩২ বছর বয়স বিভাগে ৬.৭০ স্কোর করে যৌথভাবে ব্রোঞ্জ জিতেছেন দিনাজপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার এই তায়কোয়ান্দোকার। একই স্কোর করে তাঁর সঙ্গে অন্য ব্রোঞ্জজয়ী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মাসুম খান।

অবাক করার মতো তথ্য আছে আরও একটি। ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করার নেশায় জাকির হোসেনের মার্শাল আর্ট জগতে আসা। সেখান থেকে চলে আসেন প্রায় একই ঘরানার তায়কোয়ান্দোতে। এবার নিয়ে জীবনে দুবার জাতীয় পর্যায়ের খেলায় অংশগ্রহণ করতে ঢাকা এসেছেন। দুবারই জিতলেন ব্রোঞ্জ। এর আগে প্রথম ও সর্বশেষ খেলেছিলেন ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে।

জাকির হোসেনের বাড়ি দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলায়। তফিউদ্দিন মেমোরিয়াল হাইস্কুলের গণিতের সহকারী শিক্ষক। ২০০৯ সাল থেকে তায়কোয়ান্দো অনুশীলন করেন তিনি। দুই বছর অনুশীলন করে ২০১১ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েই ব্রোঞ্জ জয়।

এমন তরুণদের সঙ্গে লড়ে জিতেছেন জাকির হোসেন।

কিন্তু ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় তাঁর তায়কোয়ান্দো খেলা। কারণ, পরিবার ও পাড়া–প্রতিবেশীদের চোখে সেটা যে ছিল ‘বুড়োর ভীমরতি’। এরপর সাত বছর তায়কোয়ান্দোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

কিন্তু এতে ৬৬ কেজি থেকে ওজন বেড়ে চলে যায় ৮২ কেজিতে। সঙ্গে শরীরে বাসা বাঁধে অসুখ। উপায় না দেখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে বললেন, ‘বাবা আবার খেলা শুরু করো।’

ব্যস ২০১৯ সালে আবার নেমে পড়লেন তায়কোয়ান্দোতে। দুই বছরের মাথায় বাংলাদেশ গেমসে খেলার সুযোগ। কিন্তু এই বয়সে পদক জেতার আশা করেছিলেন? জাকির হোসেনের জবাব, ‘না, আমি ভাবিনি পদক জিতব। কিন্তু কীভাবে যেন জিতে গেলাম।’

তায়কোয়ান্দো বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় খেলা।

পদক জেতার চেয়ে বড় প্রশ্ন, এই বয়সে খেলার অনুপ্রেরণা পান কোথা থেকে? সেখানে মুক্তিযুদ্ধ আর ডাকাতের গল্প। জাকির হোসেনের মুখ থেকেই শুনুন, ‘অনুপ্রেরণা পাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ডাকাতদের বিপক্ষে লড়াই থেকে। ১৯৭১ সালের স্মৃতি এখনো আমার মনে আছে। দুম, দুম—(মুখে গুলির শব্দ করে)। আমি দৌড়াচ্ছি। স্বাধীনতার পর শুরু হলো আমাদের এলাকায় ডাকাতের ভয়। আরও অনেক বছর পর আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়ল। ডাকাতেরা আমার ভাইকে গুলি করে জখম করল। আমার জীবন পাল্টে গেল। আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্ট জগতে ঢুকলাম। এরপর তায়কোয়ান্দো। এখনো ওই মুক্তিযুদ্ধ ও ডাকাতদের পেছনে দৌড়ানোর স্মৃতিই আমার অনুপ্রেরণা।’

এ ছাড়া বেদবাক্যের মতো একটা কথা—খেললে শরীর সুস্থ ও সবল থাকার কারণটাও জানিয়ে রাখলেন তিনি!