স্ত্রীর সঙ্গে সিদ্দিকুর।
স্ত্রীর সঙ্গে সিদ্দিকুর।

দেশের বাইরে ঈদ

সুইজারল্যান্ডে সেমাই নিয়ে গিয়েছিলেন সিদ্দিকুরের স্ত্রী

ঈদ মানে আনন্দ। অথচ দুই বছর আগের এক ঈদের দিনে সেই আনন্দটাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না ফুটবলার মামুনুল ইসলাম। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল তখন লাওসে। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রাক্‌-বাছাইপর্ব খেলতে লাওসের বিপক্ষে ঈদের পরদিন মাঠে নামে বাংলাদেশ। ওই দলের হয়ে মামুনুলও গিয়েছিলেন লাওস।

ব্যাপারটা এমন নয় যে সেবারই প্রথম খেলতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে ঈদ করা। ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে একাধিক দেশে ঈদের দিন ফুটবল খেলেছেন মিডফিল্ডার মামুনুল। কিন্তু ২০১৯ সালের ঈদটা তাঁর জন্য ছিল অন্য রকম। একমাত্র ছেলে মুহাইমিনুল ইসলামের জন্ম যে ওই বছরেই! ছেলের জীবনের প্রথম ঈদে কাছে থাকতে না পারার দুঃখটা সেদিন বড় হয়ে উঠেছিল মামুনুলের কাছে।

খেলাধুলার আন্তর্জাতিক সূচিতে ঈদের ছুটি বলে কিছু নেই। তাই শুধু মামুনুল নন, হকির স্ট্রাইকার রাসেল মাহমুদ জিমি, গলফার সিদ্দিকুর রহমান, দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার, ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার, শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকিদেরও বিভিন্ন সময়ে খেলার জন্য ঈদের দিনে থাকতে হয়েছে দেশের বাইরে। ঈদের আনন্দ ভাগ করতে গিয়ে কখনো অন্যের পরিবারই হয়ে উঠেছেন আপনজন। আবার পরিবারের সঙ্গে না থাকায় কারও কাছে ঈদের দিনটাকেও মনে হয়েছে আর আট-দশটা সাধারণ দিনের মতোই!

জার্মানিতে সতীর্থদের সঙ্গে রাসেল মাহমুদ জিমি।

জাতীয় দল ও ক্লাব লিগে খেলতে চীন, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, মালয়েশিয়ায় ঈদ করতে হয়েছে জিমিকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের এশিয়ান গেমস হকিতে ঈদের দিন তাজিকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছে বাংলাদেশ দল। ওই দলের আক্রমণভাগের বড় ভরসা ছিলেন জিমি। জার্মানির ঘরোয়া হকি লিগে খেলতে গিয়ে জিমির সঙ্গে পরিচয় হয় সে দেশের কিছু প্রবাসী বাঙালি পরিবারের।

পরিচয়টা এতই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে এখনো জিমি তাঁদের নিজের পরিবারের সদস্য বলেই মনে করেন, ‘একবার জার্মানিতে খেলার সময় ঈদের দিন প্রচণ্ড মন খারাপ করে বসে ছিলাম। ওখানকার একজন প্রবাসী বাঙালি খবরটা শুনে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে দশ ঘর বাঙালি আছে। ওরা আমাকে সেদিন এত আদর-যত্ন করে খাইয়েছিল যে আজও তা ভুলিনি। এরপর যতবারই জার্মানি খেলতে গেছি, ওরা আমার খেলা দেখতে এসেছে। এখনো তারা আমার খোঁজখবর নেয়।’

লাওসে ঈদের নামাজের পর ফুটবলারদের সেলফি।

লাওসে ঈদের দিন সকালে ভিয়েনতিয়েনের জামে মসজিদে নামাজ পড়েন ফুটবলাররা। নামাজ শেষে সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। পরিবার-পরিজনকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট ছিল ফুটবলারদের মনে। কিন্তু দেশের স্বার্থেই সবাই তা মেনে নেন। মামুনুল স্মৃতি হাতড়ে সেই কথাটাই বলছিলেন, ‘ঈদের যে আনন্দ পরিবারের সঙ্গে করা যায়, সেটা তো সতীর্থদের সঙ্গে হবে না। আসলে দেশে থাকলে একরকম আনন্দ, বিদেশে আরেক রকম। দেশের হয়ে খেলতে বাইরে গেলে দায়িত্ব থাকে দলকে জেতানোর। তাই ঈদের আনন্দের চেয়ে খেলার দিকেই মন থাকে বেশি।’ শেষ পর্যন্ত রবিউল ইসলামের একমাত্র গোলে পাওয়া জয়টা ফুটবলারদের ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েক গুণ।

করোনার আগে কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক ট্যুরে খেলতে বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে গলফার সিদ্দিকুর রহমানকে। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপানে একাধিক ঈদের দিনে খেলতে হয়েছে দেশসেরা গলফারকে। বিদেশের মাটিতে এতগুলো ঈদের ভিড়ে সুইজারল্যান্ডের ঈদটাকে একটু আলাদা করেই রেখেছেন সিদ্দিকুর, ‘বিয়ের পর সেবারই প্রথম ঈদ ছিল আমাদের। সুইজারল্যান্ডে স্ত্রী অরনিকে (সামাউন আঞ্জুম) নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়েই খেলতে চলে গিয়েছিলাম। শুধু সকালে দুজন দুজনকে ঈদ মোবারক বলেছিলাম।’ সিদ্দিকুর সেমাই পছন্দ করেন বলে স্ত্রী অরনি ঢাকা থেকে ঈদের সেমাই নিয়ে গিয়েছিলেন সেবার।

অ্যাথলেটিকসে টানা ১২ বারের দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার দেশের বাইরে ঈদ করেছেন দুবার। একবার ২০১৪ গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে। এরপর ২০১৭ সালে গ্রিসের এথেন্সে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির আমন্ত্রণে ইন্টারন্যাশনাল সেশন ফর ইয়াং পার্টিসিপেন্টস কর্মসূচিতে। এথেন্সে ঈদের পুরো দিন ব্যস্ত ছিলেন ডিপ্লোমা কর্মশালার ক্লাসে। ভিন্ন সংস্কৃতির দেশে গিয়ে ঈদটা বেমালুম ভুলতেই বসেছিলেন তিনি। কর্মসূচিতে সঙ্গী ছিলেন বাংলাদেশের ভলিবল খেলোয়াড় আল জাবির। সে ঈদের কথা মনে পড়তেই শিরিন বলছিলেন, ‘আমরা দুজন ছাড়া ঈদের বিষয়টা অন্য কেউ বুঝতেই পারেনি। সারা দিন ক্লাস করতে হয়েছিল। ইউরোপিয়ান খাবার খেয়েছিলাম ডাইনিংয়ে। ক্লাস শেষে দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শুধু হাসছিলাম। আর বলছিলাম আজ কি ঈদ!’

ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমসের ভিলেজে ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার।

২০১৮ এশিয়ান গেমসে জাকার্তায় খেলতে গিয়ে ঈদ আনন্দ মাটি হয়েছিল এসএ গেমসে সোনাজয়ী মাবিয়া আক্তারের, ‘আমার কখনোই মনে হয়নি যে ঈদের দিন ছিল সেটা। গেমস ভিলেজে ছিলাম বলে ঈদটাই মাটি হয়েছিল। পরের দিন খেলা ছিল তাই হাতে মেহেদি পরতে পারিনি। কোনো বিশেষ খাবারও ছিল না। আমার মন খারাপ দেখে ফিরোজা আপা (কোচ, ফিরোজা পারভীন) সালামি দিয়েছিলেন।’