শেবাগের ওপেনিং-সঙ্গী থেকে অলিম্পিকে শুটার

মাইরাজ আহমেদ খান।
ছবি: অলিম্পিকডটকম।

পেছনে তাকিয়ে মাইরাজ আহমেদ খানের হয়তো এখন নিজেরই পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করে। ভাগ্যিস, ঠিক সময়ে ক্রিকেট ছেড়ে শুটিংয়ে এসেছিলেন!

ক্রিকেটেই ছিল মাইরাজের বেড়ে ওঠা। একেবারে ক্রিকেটে শ্বাস, ক্রিকেটে বাস। ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করতেন, একটা সময়ে ভারতের সাবেক ওপেনার বীরেন্দর শেবাগের সঙ্গে উদ্বোধনী জুটিতেও নামার স্মৃতি আছে তাঁর। কিন্তু ক্রিকেটে কিছু হবে না বুঝতে পেরে কঠিন এক সিদ্ধান্তই নেন মাইরাজ। ব্যাট ছেড়ে হাতে তুলে নেন শুটিংয়ের বন্দুক। পেশা বদলে ভাগ্যবদল!

আজ যখন অলিম্পিকে তিন রঙা পতাকা নিয়ে মার্চ করল ভারতীয় দল, সে দলের অংশ মাইরাজও। ৪৫ বছর বয়সে বন্দুক হাতে টোকিওতে মাইরাজ ছুটবেন পদকের স্বপ্ন নিয়ে! আগামী পরশু ছেলেদের স্কিট শুটিংয়ের বাছাই পর্বে নামবেন তিনি।

ভারতের সাবেক ওপেনার বীরেন্দর শেবাগ।

ভারতের মতো ক্রিকেট-পাগল দেশে আর দশজন তরুণের মতো ক্রিকেটেই স্বপ্ন বুনেছিলেন মাইরাজ। শেবাগের সঙ্গে একই দলে খেলার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। সেখান থেকে ক্রিকেট ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত সহজ তো হওয়ার কথা নয়! কিন্তু মাইরাজ সে কঠিন সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন।

নিজের সামর্থ্য-সীমাবদ্ধতা সেই বয়সেই বুঝে পেশা নির্ধারণ, একটা স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আরেকটা স্বপ্ন বোনার ক্ষমতা কজনের থাকে! মাইরাজের ছিল।

শেবাগের সঙ্গে তাঁর একসঙ্গে ইনিংস উদ্বোধন করা অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্রিকেটে। তত দিনে মাইরাজের কিছু নামডাক হয়েছে বটে! উত্তর প্রদেশের বুলান্দশহর জেলা থেকে বেড়ে ওঠা মাইরাজ ভিনু মানকড় ট্রফিতে তাঁর রাজ্যের অনূর্ধ্ব-১৬ দলের অধিনায়ক ছিলেন, সিকে নাইডু ট্রফিতেও উত্তর প্রদেশের হয়ে খেলেছেন। আর শেবাগের সঙ্গে ইনিংস উদ্বোধনের ঘটনাটা ১৯৯৬ সালের।

ও (শেবাগ) সেই ম্যাচে ৩৮ বা ৩৯ বলে ৭৪ রানের বিধ্বংসী একটা ইনিংস খেলেছিল। আমি ১৯ রানেই আউট হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ম্যাচটা জিতেছি।
বীরেন্দর শেবাগের সঙ্গে ইনিংস উদ্বোধনের স্মৃতি মাইরাজের

পাঞ্জাবের ঝালান্দার আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা চলছিল। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমেছিলেন শেবাগ-মাইরাজ। তখনো শেবাগ তো আর তারকা নন, তবু স্মৃতিটা এখনো জ্বলজ্বলে মাইরাজের, ‘ও সেই ম্যাচে ৩৮ বা ৩৯ বলে ৭৪ রানের বিধ্বংসী একটা ইনিংস খেলেছিল। আমি ১৯ রানেই আউট হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ম্যাচটা জিতেছি।’

দুজনের সেদিনের ইনিংসের মতোই হলো ক্রিকেটে দুজনের পথচলা। শেবাগ সেখান থেকে ভারতের জাতীয় দলের ব্যাটিংয়ের খোলনলচেই অনেকটা বদলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সবার তো আর শেবাগ হওয়া হয় না। কেউ কেউ মাইরাজও হন!

শেবাগ ছাড়াও পরে ভারতের জাতীয় দলে খেলা ঋষিকেশ কানিৎকার, মোহাম্মদ সাইফ (ভারতের সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ কাইফের ভাই), বিজয় দাহিয়ার মতো ক্রিকেটারের সঙ্গে কিংবা বিপক্ষে খেলেছেন মাইরাজ। কিন্তু তাঁর ক্রিকেট সামর্থ্য দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না বুঝতে পেরে ক্রিকেটই ছেড়ে দেন মাইরাজ, চলে আসেন শুটিংয়ে।

শুটিংয়ে অল্পবিস্তর আগ্রহ এমনিতেই ছিল তাঁর। ভারতের সাবেক অলিম্পিয়ান ও পরে শুটিংয়ে কোচ বনে যাওয়া মানশের সিংয়ের সান্নিধ্যে এসে শুটিংয়ে প্রেম জাগে মাইরাজের। ক্রিকেটে না হোক, ভারতের তিন রঙা পতাকার প্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন শুটিংয়েই পূরণ হলো তাঁর! এই গত মে মাসেই ইতালির লোনাতোতে বিশ্বকাপে খেলেছেন মাইরাজ।

অলিম্পিকে অবশ্য এবারই প্রথম নন মাইরাজ। ২০১৬ রিও অলিম্পিকেও কোটায় জায়গা পেয়েছিলেন। কিন্তু সেবার চূড়ান্ত পর্বে যাওয়া হয়নি তাঁর। তা একবার না পারিলে দেখো দ্বিতীয়বার! পাঁচ বছর পর, ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসেও অলিম্পিকে কিছু করে দেখানোর ক্ষুধা এখনো মাইরাজের মনে শিহরণ জাগায়।

টোকিও অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য নিজেকে এই ৪৫ বছর বয়সেও ফিট রাখার চেষ্টায় কোনো কমতি রাখেননি। তাঁর দিন শুরু হয় স্ট্রেচিং ও ফোম রোলিং দিয়ে, মাঝে মাঝে ‘টারমেরিক লাটে’ (হলুদচূর্ণ, দারুচিনি, আদা দিয়ে বানানো পানীয়) পান করে।

এ সবকিছুই শুধু খেলার সর্বোচ্চ মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার। আর গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের চেয়ে বড় মঞ্চ আর কী হতে পারে!