হার না মানার গল্প

শূন্য সম্ভাবনা, শেষ প্রার্থনা

করোনার দিনে এত আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবরে মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর চেয়ে কিছু অনুপ্রেরণার গল্প শুনলে কেমনহয়? আঘাত, চোট, বদভ্যাস থেকে ফিরে আসার গল্প তো অনেকই আছে খেলার জগতে। তাঁর দ্বিতীয় পর্বে আজ কিংবদন্তি মোটোরেসার নিকি লাউডা ও বিতর্কিত সাইক্লিস্ট ল্যান্স আর্মস্ট্রংয়ের গল্প -
নিকি লাউডা। ফাইল ছবি
নিকি লাউডা। ফাইল ছবি


যেন নিজেরই ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন

বিত্তশালী পরিবারের কাগজ তৈরির ব্যবসা ছিল। অস্ট্রিয়ায় বেশ নামডাক ছিল তাঁর দাদা শিল্পপতি হানস লাউডার। ছেলে বড় হয়ে ব্যবসার কাজে মন দেবে, এমনই হয়তো ভেবেছিল নিকি লাউডার পরিবার। সেই নিকিই যখন জানাল, ব্যবসা নয়, তাঁর মন পড়ে আছে মোটো রেসিংয়ে, পরিবার সহজে মেনে নেওয়ার কথা নয়। নেয়ওনি। তখন যদি পরিবার বুঝতে পারত, এই ছেলেই একদিন তিনবার ফর্মুলা ওয়ান বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জিতবে, হবে খেলাটার দুই সফলতম প্রতিষ্ঠান ফেরারি ও ম্যাকলারেনকে প্রতিনিধিত্ব করা ইতিহাসের একমাত্র ড্রাইভার!

পরিবারের কাছ থেকে কানাকড়িও পাননি, মিনি কার দিয়ে রেসিং ক্যারিয়ারের নিচু স্তর থেকে শুরু করা লাউডা আর কী করবেন! ধীরে ধীরে উঠতে থাকার এক পর্যায়ে–১৯৭১ সালে, জীবনবিমার বিনিময়ে ৩০ হাজার ইউরো ঋণ নেন ব্যাংক থেকে, যেটি কাজে লাগে তাঁর দ্বিতীয় স্তর ফর্মুলা টুতে ওঠায়। নিকি লাউডার বয়স তখন ২২ বছর, তখন তিনি রেসিং কার প্রস্তুতকারক মার্চের ড্রাইভার।

ফর্মুলা ওয়ানে ওঠা পরের বছরই। কিন্তু ফর্মুলা ওয়ানে শুরুটা ভালো হলো না, যেটির পেছনে দায় অবশ্য মার্চের গাড়ির বাজে পারফরম্যান্সের। ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় দফা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্রিটিশ রেসিং মোটরসে (বিআরএম) যোগ দেন লাউডা। পরের বছরই আসে বড় চমক! লাউডা যোগ দেন ফেরারিতে! যদিও তাতে বিআরএম সতীর্থ ক্লে রেগাজ্জোনির হাত ছিল। মাত্রই ফেরারিতে যোগ দেওয়া রেগাজ্জোনির কাছে যখন লাউডার ব্যাপারে জানতে চান ফেরারির মালিক এনজো ফেরারি, লাউডার ড্রাইভিংয়ের দারুণ সুনাম করেন রেগাজ্জোনি। ফেরারি তাই তখনো অনেকটা অখ্যাত লাউডাকে নিতে আর দেরি করেনি। তাঁর ব্যাংকের ঋণও শোধ করে দেয় ফেরারি।

এরপর শুধু ফেরারির গতিতে সামনে এগিয়ে চলার কথা ছিল। কিছুটা চলেছেও। ১৯৭৫ সালেই ফেরারিকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ এনে দেন লাউডা-রেগাজ্জোনি, ১১ বছরে যা ফেরারির প্রথম। ১৯৭৬ মৌসুমেও শুরুটা অসাধারণ ছিল তাঁর, প্রথম ছয় রেসের চারটিই জিতেছিলেন, বাকি দুটিতে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। শিরোপার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জোডি শেকটার ও জেমস হান্টের সঙ্গে তাঁর পয়েন্টের ব্যবধান ছিল দ্বিগুণেরও বেশি! টানা দ্বিতীয় বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ মনে হচ্ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।

তা হতে দিল না ১৯৭৬ সালের ১ আগস্ট জার্মান গ্রাঁ প্রি-র সেই বিভীষিকা। নুরবুরগ্রিংয়ের সেই ট্র্যাকে সে সময় লাউডাই ছিলেন দ্রুততম রেসার। কিন্তু রেসের এক সপ্তাহ আগে লাউডা অন্য রেসারদের অনুরোধ জানান এই ট্র্যাকে রেস বয়কট করতে। কারণ, ট্র্যাকে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থায় ঘাটতি ছিল। সে সময় ফর্মুলা ওয়ান অনেক ভয়ংকরও ছিল, দুর্ঘটনা ছিল নিয়মিত ব্যাপার।সেদিন যাঁদের অনুরোধ করেছিলেন লাউডা, তাঁদের মধ্যে তিনজন পরের চার বছরে রেসিং ট্র্যাকে ভিন্ন তিন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান!

সেই ভয়ংকর দৃশ্য। ফাইল ছবি

কিন্তু সেদিন লাউডার অনুরোধ বেশিরভাগই শোনেনি। রেস চলল। নিকি লাউডা আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জেমস হান্টকে নিয়ে নির্মিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'রাশ'- এ দেখা যায়, লাউডা ভয় পাচ্ছেন ভেবে হান্টসহ অনেকে সেই প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু কে জানে, লাউডা নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন কি না! দ্বিতীয় ল্যাপেই দুর্ঘটনায় লাউডার ফেরারি। সংঘর্ষ হলো ব্রেটলাঙ্গারের ফোর্ডের সঙ্গে। ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়ল ফেরারি, পাশের বাঁধে ধাক্কা খেল। দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল গাড়িতে।কিন্তু লাউডা আটকে পড়েন ভেতরে। অনেক কষ্টে তাঁকে যতক্ষণে বের করা হলো, লাউডার মাথায় ভীষণভাবে পুড়ে গেছে। গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তাঁর ফুসফুস। তখন সজ্ঞান থাকলেও পরে কোমায় চলে যান লাউডা। হাসপাতালে একটা সময় শেষ প্রার্থনাও পড়া হয়েছিল তাঁর জন্য।

কিন্তু ভাগ্য সহায়, সেখান থেকেই ফিরে আসেন লাউডা! এসেছেন তো এসেছেন, ছয় সপ্তাহের মধ্যেই আবার নেমে পড়লেন রেসিংট্র্যাকে। সংবাদ সম্মেলনে যখন এলেন, তাঁর মুখে তখনো ব্যান্ডেজ! সেবার শিরোপা আর জেতা হয়নি, তবে লাউডার তিন বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের দুটিই এসেছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরার পর।

বিতর্কের আগের তিনি
১৯৯৯ থেকে ২০০৫–টানা সাতটি ট্যুর দো ফ্রান্স। সাইক্লিংয়ের ইতিহাসে যা আর কারও নেই। এতটুকু বলার পর সম্ভবত নামটা আর না বললেও চলে। ল্যান্স আর্মস্ট্রংয়ের কীর্তিই তাঁকে সাইক্লিং ছাড়িয়ে বিশ্বে বিখ্যাত করে রেখেছে।

প্রথমবার ট্যুর দো ফ্রান্স জয়ের পরই তাঁর বিরুদ্ধে ডোপিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় বারবার অস্বীকার করে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডোপিং বিরোধী সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হয়, তিনি পারফরম্যান্সবর্ধক ড্রাগ নিয়েই নামতেন।তদন্ত প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, তিনিই ছিলেন 'সাইক্লিংয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে সংগঠিত, পেশাদার ও জটিল ডোপিংপ্রকল্পের' মূল হোতা। সাতটি ট্যুর দো ফ্রান্স শিরোপাসহ ১৯৯৮ সালের পর থেকে তাঁর জেতা সব শিরোপাই বাতিল করা হয়, যারমধ্যে ২০০০ অলিম্পিকে জেতা ব্রোঞ্জ পদকটাও ছিল। সাইক্লিং তো বটেই, বিশ্ব ডোপিং বিরোধী সংস্থার (ওয়াডা) যত খেলা আছে, সব খেলা থেকে তাঁকে আজীবন নিষিদ্ধও করা হয়! ল্যান্স আর্মস্ট্রংয়ের কুকীর্তিও সাইক্লিং ছাড়িয়ে তাঁকে বিশ্বে বিতর্কিত করেরেখেছে।

সাইক্লিস্ট ল্যান্স আর্মস্ট্রং। ছবি: টুইটার

তবে বিতর্ককে এক পাশে রাখলে, খেলার ইতিহাসে মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে দারুণভাবে ফিরে আসার গল্প যতবার লেখা হবে, আর্মস্ট্রংয়ের নাম থাকবে ওপরের দিকেই। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর, আর্মস্ট্রংয়ের বয়স যখন ২৫, তাঁর মূত্রথলীর ক্যানসার ধরাপড়ে। তা-ও শুরুর পর্যায়ে নয়, একেবারে স্টেজ থ্রি! পরের দিনই অস্ত্রোপচার করে আক্রান্ত মূত্রথলী ফেলে দেওয়া হয়।

তার কদিন আগেই মাথা ব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, কফে রক্ত ও ফুলে যাওয়া মূত্রথলী নিয়ে ইউরোলজিস্ট জিম রিভসের কাছেগিয়েছিলেন আর্মস্ট্রং। যুক্তরাষ্ট্রের সাইক্লিস্টের বাঁচার সম্ভাবনা কতটা ছিল, তা জানাতে গিয়ে রিভস পরে এক সাক্ষাৎকারেবলেছিলেন, 'বলতে গেলে ছিলই না। আমরা ল্যান্সকে শুরুতে বলেছিলাম ২০ থেকে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে বেঁচে ফেরার, তবে সেটা মূলত তাঁকে আশা দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। তাঁর ক্যানসার যে পর্যায়ে ছিল, তাতে বলতে গেলে কোনো আশাই ছিল না।'

ভ্যান্ডারবেল্ট ইউনিভার্সিটির অনকোলোজিস্ট স্টিভেন উলফের কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার পর ইন্ডিয়ানাপোলিসের ইন্ডিয়ানাইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আর্মস্ট্রং। ১৯৯৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ ক্যামোথেরাপি নেন আর্মস্ট্রং।

যেন বন্দিদশা থেকে মুক্তি! জানুয়ারি থেকেই মৃদু অনুশীলনে নেমে পড়া তাঁর। ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে ক্যানসারমুক্ত ঘোষণা করা হলো। কিন্তু প্রায় দুই বছরের কেমোথেরাপি আর এত দূর এগিয়ে যাওয়া ক্যানসারের ধকল কাটিয়ে ফেরা তো আর সহজ কম্মো নয়। শারীরিক ও মানসিক ফিটনেস ফিরে পেয়ে ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু আর্মস্ট্রংয়ের কঠোর অনুশীলন।

এরপরের গল্পটা তো সবারই জানা। টানা সাত ট্যুর দো ফ্রান্স আর ডোপিংয়ের কালো অধ্যায়।