শুটিংয়ে উন্নতি করতে হলে অর্থ খরচ করতেই হবে, বললেন দক্ষিণ কোরীয় কোচ কিম।
শুটিংয়ে উন্নতি করতে হলে অর্থ খরচ করতেই হবে, বললেন দক্ষিণ কোরীয় কোচ কিম।

সাক্ষাৎকারে শুটিং কোচ কিম ইল ইয়ং

শুটিংয়ে ওপরে যেতে টাকা খরচ করতেই হবে

বাংলাদেশের শুটিং যেন পথ হারিয়েছে! সর্বশেষ ২০১৯ কাঠমান্ডু এসএ গেমসে আসেনি একটিও সোনা। শুটারদের স্কোর নেই প্রত্যাশিত মানে। কেন শুটিং পিছিয়ে পড়ছে? কোথায় সমস্যা? এসব নিয়েই কাল প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন ১৪ মে নতুন করে বাংলাদেশ শুটিং দলের দায়িত্ব নেওয়া দক্ষিণ কোরিয়ান পিস্তল কোচ কিম ইল ইয়ং।
প্রশ্ন

তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশ শুটিং দলের কোচ হলেন। আগের দুবারের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

কিম ইল ইয়ং: ২০১৬ সালে প্রথমবার মাত্র মাস তিনেক ছিলাম। তখন সবকিছু ভালোভাবে বুঝে ওঠা হয়নি। তবে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নেপালে দক্ষিণ এশিয়ান গেমস পর্যন্ত কাজ করেছি। গতবারের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না তেমন।

প্রশ্ন

কেন ভালো ছিল না?

কিম ইল: আগেরবার ঢাকায় যে পরিস্থিতিতে কাজ করেছি, সেটাকে খুবই খারাপ বলব। তখন শুটারদের সহায়তা করা হতো না। ভালো কোচিংও পাননি শুটাররা। ফেডারেশনের ভেতর কোন্দল ছিল। এসব কারণে আমি দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের পর দেশে ফিরে যাই। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। নতুন কমিটি এসেছে। তাই আবার ফিরে এসেছি।

তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের শুটিংয়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন কিম।
ওপরের দিকে তখনই যাবে, যখন অনেক টাকা খরচ করবেন। ভারতসহ অনেক দেশই শুটিংয়ে অর্থ ঢালছে। সেটা হতে পারে বাংলাদেশের চেয়ে ১০০ গুণ বা তার বেশি।
কিম ইল ইয়ং, বাংলাদেশের শুটিং কোচ
প্রশ্ন

আপনার অধীনে গত কাঠমান্ডু এসএ গেমসে পিস্তলে কোনো সোনা পায়নি বাংলাদেশ, রাইফেলেও নয়। অথচ ২০১৬ গুয়াহাটি এসএ গেমসে শাকিল আহমেদ পিস্তলে সোনা জিতেছিলেন।

কিম ইল: ২০১৯ এসএ গেমসে আমরা পিস্তলে রুপা এবং ব্রোঞ্জ জিতেছি। মেয়েদের বিভাগে এবারই প্রথম ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে ব্যক্তিগত রুপা জিতেছেন আরদিনা ফেরদৌস। দলীয় রুপাও আসে। মিশ্র দ্বৈতে শাকিল আর আরদিনা ব্রোঞ্জ পেয়েছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় ভালো ফলই বলতে হবে। তবে গত এসএ গেমসে কী হয়েছে, কেন সোনা আসেনি, সে অনেক কাহিনি। সেসব নিয়ে বলতে চাই না। তবে এটা বলব, তখন আমরা অনুশীলনে পর্যাপ্ত গুলি পাইনি।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্নায়ু ধরে রাখতে সমস্যা বাংলাদেশি শুটারদের
প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের শুটারদের ভালো করতে না পারার কারণ কী?

কিম ইল: কারণ তো অনেক। শুটিংয়ের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চাই। দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ হাজারের বেশি শুটার আছেন। চীনে ২০ হাজারের বেশি। ভারতেও কয়েক হাজার। অথচ বাংলাদেশে শুটারের সংখ্যা মাত্র ২০০-৩০০। সেটাও একেবারে প্রাথমিক স্তরে থাকা শুটারসহ। উন্নতির জন্য প্রথমত শুটারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। অনেকের মধ্য থেকেই উঠে আসবে আগামীর ভবিষ্যৎ।

প্রশ্ন

কিন্তু নব্বই দশকেও ভারতের মতো দেশ পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে। এখন কেন এই শূন্যতা?

কিম ইল: বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে হবে। বিশ্ব শুটিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের শুটিংয়ে বিস্তর ব্যবধান। বাংলাদেশের মান অনেক নিচের দিকে। ওপরের দিকে তখনই যাবে, যখন অনেক টাকা খরচ করবেন। ভারতসহ অনেক দেশই শুটিংয়ে অর্থ ঢালছে। সেটা হতে পারে বাংলাদেশের চেয়ে ১০০ গুণ বা তার বেশি।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে তাহলে কী বলবেন?

কিম ইল: সম্ভাবনা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু পরিচর্যা জরুরি। অনেক অর্থ দরকার। এ জন্য সরকারের সহায়তা চাই। সব রকম সহায়তা পেলে এবং নিজেদের প্রতি বিশ্বাস রাখলে তরুণেরা ভবিষ্যতে ভালো করবে।

প্রশ্ন

এবার এসে আপনি কী লক্ষ্য স্থির করলেন?

কিম ইল: শুটারদের আরেকটু উঁচু স্তরে নিয়ে যাওয়াই আমার লক্ষ্য। জয়ের লক্ষ্য নিয়েই বাংলাদেশে ফিরেছি। বাংলাদেশ তাকিয়ে থাকে এসএ গেমসের পদকের দিকে। কিন্তু এসএ গেমস আমার লক্ষ্য নয়। ওটা একটা আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা। আমি দৃষ্টিটাকে বড় পরিসরে মেলে ধরছি। লক্ষ্য স্থির করেছি অনেক বড়। বিশ্বকাপে পদক জিততে চাই।

প্রশ্ন

লক্ষ্য পূরণে কী পরিকল্পনা আপনার?

কিম ইল: করোনাকাল চলছে এখন। অনেক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট বন্ধ বা বাতিল হয়ে গেছে। তবে সামনে অলিম্পিক। তার আগে আজারবাইজানের বাকুতেও একটি প্রতিযোগিতা আছে। ভিয়েতনামে টুর্নামেন্ট আছে। ফেডারেশন কী সিদ্ধান্ত নেয় জানি না। ঢাকায় এসে এক সপ্তাহের কোয়ারেন্টিনে আছি। শনিবার করোনা পরীক্ষার পর কাজে নামব। অলিম্পিকের জন্য শাকিল ক্যাম্পে আছেন, তাঁকে অনুশীলন করাব। সামনে নতুন খেলোয়াড়দের নিয়েও অনুশীলন শুরু হবে বলে জানিয়েছে ফেডারেশন।

শুটিয়ের সুযোগ–সুবিধাও বাড়ানোর তাগিদ শুটিং কোচের।
প্রশ্ন

ঢাকায় গুলশান রেঞ্জটা মোটামুটি যুগের সঙ্গে চলনসই। কিন্তু সারা দেশে শুটিংয়ে অবকাঠামো খুবই ভঙ্গুর। শুটিংয়ের উন্নয়নে ভালো অবকাঠামোর অভাব কতটা অন্তরায়?

কিম ইল: অনেক বড় অন্তরায়। এখানে শুটিংয়ের সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। আরও কিছু ভালো রেঞ্জ দরকার। আমাদের এখন বেশি দরকার নতুন অস্ত্র, নতুন গুলি। এগুলোর সমস্যা ছিল গত এসএ গেমসের সময়। আপনি যদি এখন অস্ত্র পরিবর্তন না করেন, আধুনিক গুলি না দেন শুটারদের তাহলে ভালো স্কোর আসবে না। তা ছাড়া শুটারদের আর্থিক নিশ্চয়তা দেওয়া এবং তাদের বিদেশে পাঠানো দরকার। ভালো ভালো খেলোয়াড়ের বিপরীতে খেলার সুযোগ করে দেওয়াও জরুরি। বছরে অন্তত ৬-৭টি বা আরও বেশি টুর্নামেন্টে খেলতে হবে।

প্রশ্ন

অতীতে রাইফেল শুটিংয়ে বড় কিছু সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। পিস্তলে যাত্রা শুরু বেশি দিন নয়। দুটো মিলিয়েই কেমন দেখছেন বাংলাদেশের শুটিংয়ের ভবিষ্যৎ?

কিম ইল: রাইফেল নিয়ে আমি বলতে পারব না। কারণ, আমি পিস্তল নিয়ে কাজ করছি। বাংলাদেশের শুটিংয়ে পিস্তল ইভেন্টের মান হয়তো এখনো কাঙ্ক্ষিত স্তরে যেতে পারেনি। তবে শুটারদের স্কোর বাড়ছে। আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। সমস্যা হলো শুটারদের অভিজ্ঞতায়। শুটাররা যদি অনেক বেশি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেত, তাহলে অভিজ্ঞতা বাড়ত। আমি দেখেছি, বাংলাদেশের শুটাররা বড় আসরে স্নায়ুর চাপ সামলাতে পারে কম। স্নায়ু শক্তি বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন

বিশ্ব শুটিংয়ে দক্ষিণ কোরিয়া তো পরাশক্তি। কোরিয়ার শুটিং সাফল্যের রহস্য কী?

কিম ইল: ভালো ভালো শুটার তৈরি করেছে কোরিয়া, এটাই সাফল্যের রহস্য। কোরিয়ার শুটিংয়ের মান অনেক উঁচুতে। আমাদের দেশে অনেক কোচ আছেন। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে কোচিং করাচ্ছেন। নতুন নতুন শুটার তৈরি করছেন। সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীনসহ অন্তত ৭-৮টি দেশের কথা বলতে পারি, যেখানে কোরিয়ান কোচরা কাজ করছে। আমি কাজ করছি বাংলাদেশে।