শুটার দম্পতির স্বপ্ন, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেশের হয়ে সোনার পদক জয়

নাজিফা নাতাশা ও শাকিল আহমেদ।
ছবি: সংগৃহীত

‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি’—হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত এই গানের কলির মতোই শুটিং ফেডারেশনে অনুশীলনে এসে নাজিফা নাতাশাকে দূর থেকে দেখতেন শাকিল আহমেদ। দেখা থেকে ভালো লাগা। আর সেই ভালো লাগা ভালোবাসায় বদলে যেতে সময় লাগেনি। এসএ গেমসে সোনাজয়ী শুটার শাকিল আহমেদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত ঘর বেঁধেছেন আরেক শুটার নাতাশা।

পরিবারের উৎসাহেই শুটিংয়ে আসা নাতাশার। ২০১৫ সালে ফেডারেশনের প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচির আওতায় বিশেষ প্রশিক্ষণে অংশ নেন সিরাজগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের এই শুটার। অন্যদের মুখে নাতাশার রূপের প্রশংসা শুনে তাঁকে কাছ থেকে দেখার কৌতূহল জাগে শাকিলের। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা শেষে ঢাকায় এসে সতীর্থ বন্ধু শুটারদের মুখে শোনেন নাতাশার কথা। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় শাকিলের, ‘আমি তখন দেশের বাইরে খেলতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে বন্ধুদের মুখে শুনি ওর কথা। সবাই বলছিল, ভীষণ সুন্দরী এক মেয়ে শুটিংয়ে এসেছে। আমি ওদের কথা শুনেই নাতাশাদের অনুশীলন দেখতে যাই একদিন। প্রথম দিন ওকে দেখেই মুগ্ধ হই। ভালো লেগে যায়।’

দুজনই ভীষণ ঘুরতে পছন্দ করেন।

ফেসবুকের মাধ্যমে প্রথম নাতাশাকে ভালো লাগার কথা জানান শাকিল। কিন্তু দুজনের কেউই পরিবারকে নিজেদের পছন্দের কথা বলতে পারেননি শুরুতে। সুযোগটা আসে শাকিল ২০১৬ গুয়াহাটি এসএ গেমসে সোনা জিতলে। ওই বছরই কক্সবাজারে সোনাজয়ী শুটারদের সংবর্ধনা দেয় ফেডারেশন। একই সময়ে কক্সবাজারে হয় আন্তঃক্লাব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ। ওই প্রতিযোগিতার পর নাতাশাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা গভীর হয় শাকিলের, ‘কক্সবাজারে আন্তঃক্লাব শুটিংয়ে অংশ নেয় নাতাশা। ওই সময় ওদের পরিবারের সবাই কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল। আমাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটাও কক্সবাজারে হয়েছিল। সেখানেই ওদের পরিবারের সবার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার।’

দুই পরিবারের সম্মতিতে এরপর এই শুটার দম্পতির বিয়ে হয় ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর। মজার ব্যাপার হলো, দুই বছর পর ঠিক একই তারিখে নাতাশাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেয় শাকিলের পরিবার।

তাঁদের বিশেষ দিনের স্মৃতি।

শাকিলের ইভেন্ট এয়ার পিস্তল। নাতাশা রাইফেল শুটার। শাকিল এসএ গেমসে সোনা জেতার পাশাপাশি কমনওয়েলথ গেমসে জিতেছেন রুপা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দুটি জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও কোনো পদক জেতা হয়নি নাতাশার। তবে আগামী এপ্রিলে হতে যাওয়া বাংলাদেশ গেমস নিয়ে ভীষণ আশাবাদী, ‘ঘরসংসার সামলে যতটুকু পারছি অনুশীলন করছি। বাংলাদেশ গেমসে আশা করি ভালো কিছু করতে পারব।’

শাকিলের জন্য বিশেষ বিশেষ খাবার রান্না করতেই ভালোবাসেন নাতাশা, ‘বিয়ের আগে কোনো কিছু রান্না করতে পারতাম না। কিন্তু বিয়ের পর আম্মুর কাছ থেকে রান্না শিখেছি। গরুর মাংস, খিচুড়ি, মুরগির মাংস রান্না করি। বিশেষ দিনে পুডিং, কেক বানাই।’ নাতাশার রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ শাকিল, ‘মাঝেমধ্যে অবাক হই, ও কীভাবে এত চমৎকার রান্না করে!’

যেহেতু দুজনই শুটার, তাই এটা বাড়তি সুবিধা দেয় শাকিলের, ‘আমরা দুজনই শুটার, এটা আমার জন্য বাড়তি পাওয়া। আমার কখন অনুশীলন, কত স্কোর করছি, পারফরম্যান্সের টুকিটাকি সবকিছু সে খোঁজ রাখছে। কোথায় খারাপ করছি, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সেসবও দুজন আলোচনা করি। আমার মানসিক অবস্থাও বেশ ভালো বোঝে সে। অবসরে বেশির ভাগ সময়জুড়েই আমাদের আড্ডা জমে ওঠে শুটিং নিয়ে।’

তাঁরা দুজন।

দুজনই ভীষণ ঘুরতে পছন্দ করেন। সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েন সমুদ্র আর পাহাড় দেখতে। নাতাশা কোনো কারণে অভিমান করলে বেশিক্ষণ সেটা জমিয়ে রাখতে পারেন না। শাকিলের কথায়, ‘ওকে একটু দামি উপহারের প্রতিশ্রুতি দিলে রাগ ভুলে যায়।’

নাতাশার জন্মদিনে একবার তো কাউকে না বলে সিরাজগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন শাকিল, ‘তখন পুরোদমে অনুশীলন চলছিল। কিছুতেই ছুটি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওর জন্মদিনে থাকতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিই সিরাজগঞ্জ যাব। বিকেলের অনুশীলন সেশন শেষ করেই রওনা দিলাম। ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে ফোন দিয়ে বলি, একটু বাইরে আসবে। ও তো আমাকে দেখে ভীষণ অবাক!’

ভালোবাসা দিবসে এক বেলা অনুশীলন ছিল শুটারদের। বিকেলে দুজন বেরিয়েছিলেন ঘুরতে। একান্তে সময় কাটিয়ে ভালোবাসা দিবস আর ফাগুন উৎসব উপভোগ করেছেন এই দম্পতি।

নাতাশা রাইফেল শুটার হলেও শাকিলের জন্যই পিস্তল ইভেন্টে আসতে চান, ‘আমার ইচ্ছা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেব। দুজন একই সঙ্গে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সোনার পদক নিচ্ছি, এটা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন।’