টেলিফোনের ওপ্রান্তে ইংল্যান্ডের শেফিল্ড থেকে প্রথমে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘একটু ব্যস্ত আছি। এক ঘণ্টা পর কথা বলতে পারব।’
কী নিয়ে ব্যস্ততা, তা অনুমানের বাইরে নয়। আজ ১৬ মার্চ ইংল্যান্ডের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টায় বেলগ্রেড শহরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের হয়ে বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতে। এমন স্বপ্নযাত্রার ৩৬ ঘণ্টা আগে ব্যাগ গোছগাছ নিয়ে তাঁর ব্যস্ত থাকাই স্বাভাবিক।
৩ মার্চ বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে প্রথম অংশ নিয়েই ১০০ মিটার জিতে নেওয়া ইংল্যান্ডপ্রবাসী ইমরানুর রহমানের জীবনে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। শুধু এই বিশ্ব ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপই তো নয়, এ বছর বাংলাদেশের হয়ে এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসসহ আরও অন্তত ৪টি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন তিনি।
সোমবার সন্ধ্যায় ২৮ বছরের যুবক ইমরানুর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তাঁর বদলে যাওয়া জীবনের কথাই বললেন, ‘তিন মাস আগেও আমার এত ব্যস্ততা ছিল না। এখন আমাকে একের পর এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হতে হবে।’
তবে আপাতত তিনি রোমাঞ্চিত প্রথমবার বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন ভেবে, ‘দেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতে যাচ্ছি। অনেক ভালো লাগছে। একটা স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে আমার। আমি এবং আমার পরিবার খুবই রোমাঞ্চিত। বেলগ্রেডে লাল–সবুজ পতাকা নিয়ে যাব সঙ্গে। সত্যি বলতে আমি ভীষণ আনন্দিত।’
প্রথমে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বললেও বোঝাই যাচ্ছিল নিজেকে প্রকাশ করতে সমস্যা হচ্ছে। একসময় তাই ইংরেজিতেই বলতে শুরু করলেন। জন্ম ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের শেফিল্ডে। তাঁর জন্মের আগে সিলেট থেকে তাঁর মা–বাবা ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেই সূত্রে বিলেতি সমাজে শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে এখন বাংলাদেশকে দেশের বাইরে তুলে ধরার স্বপ্ন আঁকছেন ইমরানুর। যে স্বপ্নের কথা গত ৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি, ‘এখন স্বপ্ন দেখি বিদেশের মাটিতে দেশকে পরিচিত করব। বাংলাদেশের হয়ে খেলব।’
ইমরানুরের জীবনে সেই সুযোগ এখন দুয়ারে দাঁড়িয়ে। ১৮–২২ মার্চ সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় দিনে দৌড়াবেন তিনি ৬০ মিটার স্প্রিন্টে। এর আগে এশিয়ান ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা। তবে বিশ্ব ইনডোরে লাল–সবুজের অভিষেক হচ্ছে এবারই। ইমরানুরের হাত ধরে অবশেষে একটা বৃত্ত ভাঙতে চলছে দেশের পিছিয়ে পড়া অ্যাথলেটিকস।
বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীও তাই খুব খুশি। ইমরানুর সম্পর্কে বললেন, ‘ইমরানুর ভালো মানের অ্যাথলেট বলেই ওকে বিশ্ব ইনডোরে পাঠাতে সাহস করেছে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন।’
আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। নিজের সেরা টাইমিং করতে পারলে খুশি থাকব। আপাতত এটাই আমার লক্ষ্যইমরানুর রহমান
বাংলাদেশে ইনডোর অ্যাথলেটিকসের চর্চা নেই। তবে শেফিল্ডে ঘরোয়া কিছু আসরে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নিয়েছেন ইমরানুর। কদিন আগে সেখানে দুটি প্রতিযোগিতাতেও দৌড়ান। লন্ডনের সাটক্লিফ ইনডোর গেমসে ৬০ মিটারে তাঁর টাইমিং ৬.৬৮ সেকেন্ড। ছয়জন প্রতিযোগীর মধ্যে হয়েছেন প্রথমও। তবে ৬০ মিটারে বিশ্ব রেকর্ডের সঙ্গে সেই টাইমিংয়ের অনেক ব্যবধান। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিস্টিয়ান কোলম্যানের গড়া ৬০ মিটারের বিশ্ব রেকর্ড ৬.৩৪ সেকেন্ড।
বাস্তবতা মেনে ইমরানুর তাই নিজের প্রত্যাশা খুব উঁচুতে রাখছেন না, ‘বেলগ্রেডে বিশ্ব ইনডোরে গত টোকিও অলিম্পিকের সোনাজয়ীসহ বিশ্বসেরা অ্যাথলেটরা আসবেন। সুতরাং সেখানে ভালো কিছু করা ভীষণ কঠিন।’ তবে ব্যক্তিগত সেরাটা ঢেলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে ভোলেননি, ‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। নিজের সেরা টাইমিং করতে পারলে খুশি থাকব। আপাতত এটাই আমার লক্ষ্য।’
সেই লক্ষ্য পূরণে শেফিল্ডে গত দুই মাস অনুশীলন করেছেন ২০১৬ রিও অলিম্পিকে রিলেতে ইংল্যান্ডের হয়ে রিলেতে ব্রোঞ্জজয়ী সাবেক অ্যাথলেট স্টিভ ফগের অধীনে। কোচের কাছে অনেক কিছু শেখার কথাও জানালেন, ‘কীভাবে শুরু করতে হয়, কীভাবে গতি বাড়াতে হয়... টেকনিক্যাল সবদিক নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।’
সপ্তাহে কোচের সম্মানী ৮০ পাউন্ড ( প্রায় ৯ হাজার টাকা)। এই খরচ নিজেই বহন করেছেন ইমরানুর। শেফিল্ডে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষকের চাকরির সুবাদে পাওয়া বেতন থেকে এই অর্থ জোগান দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিনিধিত্ব তো করছেন দেশের! বাংলাদেশের কি কোনো দায়িত্ব নেই তাঁর দ্রুততম মানবের অনুশীলন খরচ জোগানোর?
প্রশ্নটা করা হলে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। তবে আশার কথা শোনালেন, ‘ইংল্যান্ডে ইমরানুরের অনুশীলন এবং আনুষঙ্গিক খরচের ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তা চেয়েছি। বিওএ আশ্বাস দিয়েছে, খরচ দেবে। তাই আমরা ইমরানুরকে বলেছি, আপাতত তুমি চালিয়ে নাও। পরে আমরা দিয়ে দেব।’
ইমরানুর অবশ্য এখন এসব নিয়ে ভাবছেনই না। তাঁর ধ্যানজ্ঞান দেশের জন্য কিছু করা। লক্ষ্যটাও স্থির করে রেখেছেন। আগামী দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিততে চান। ইমরানুরের টাইমিং সেটাকে অবাস্তব মনে করাচ্ছে না। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) ১০.২৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জিতেছিলেন শ্রীলঙ্কার হিমাশা ঈশান। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কাঠমান্ডু এসএ গেমসে মালদ্বীপের সাইদ হাসান ১০০ মিটার জেতেন ১০.৪৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে।
এই টাইমিংয়ের খুব কাছাকাছি আছেন ইমরানুর। জাতীয় অ্যাথলেটিকসে তাঁর টাইমিং ছিল ১০.৫০ সেকেন্ড। যা ভেঙে দিয়েছিল ২২ বছরের পুরোনো জাতীয় রেকর্ড। ইমরানুরের ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং অবশ্য এর চেয়ে অনেক ভালো—১০.৩০ সেকেন্ড।
এই টাইমিং দেখেই আগামী এসএ গেমসে ইমরানুরের ওপর বাজি ধরছে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন। প্রয়াত শাহ আলম, মাহবুব আলম বা বিমল চন্দ্র তরফদারদের মতো স্প্রিন্টারের কথা ভেবে যে দেশ হাহাকার করে, সেই দেশে হয়তো আশার আলো হয়েই আবির্ভাব ইমরানুর রহমানের।