মেজাজ খারাপ হয়েছিল মার্টিন ফিজের বললে কম বলা হবে। নিজে পেশাদার অ্যাথলেট ছিলেন। জেতার জন্য সবটুকু নিংড়ে দিতেন। সম্ভব-অসম্ভব সব উপায়ে সেরা সাফল্য পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ তো আর এমনি এমনি জেতেননি। আর তাঁর শিষ্যের এহেন কর্ম!
ঘটনার রেশ কেটে যায়নি। বিস্মিত অভিভূত লোকজন তখনো কেউ অভিনন্দন জানাচ্ছে। কেউবা এমন কিছু শেষ কবে দেখেছেন, সে আলোচনা করছেন। এরই মাঝে জল ঢেলে দিলেন যেন ফিজ, ‘এই কাজটা ওকে মানুষ হিসেবে আরও ভালো করেছে কিন্তু ভালো অ্যাথলেট বানায়নি। সে একটা সুযোগ হাতছাড়া করেছে। জয়ই আপনাকে অ্যাথলেট হিসেবে আরও ভালো করে। আপনি জেতার জন্যই ট্র্যাকে নামেন।’
শিষ্য যে একটা আলোচনার জন্ম দেওয়ার মতো কাজ করেছেন, বহুদিন মানুষের মনের গেঁথে থাকার মতো কিছু সেটা মেনে নিয়েছেন ফিজ, 'এটা সততার অনন্য এক উদাহরণ ছিল। এমন কিছু যা এখন আর দেখা যায় না। অথবা, বলা ভালো, এমন কিছু কেউ কখনো দেখায়নি। এমন কিছু আমি জীবনেও করতাম না। আমি জেতার জন্য এ সুযোগটা নিতাম।'
এবার একটি ফিজের 'অপরাধী' ও তাঁর 'অপরাধ' সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক। ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর নাভারের বুরলাদায় ক্রস কান্ট্রি দৌড় হচ্ছিল। খুব যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রতিযোগিতা তা নয়। কিন্তু কিছুদিন আগেই লন্ডন অলিম্পিকে ৩০০০ মিটার স্টিপল চেজের ব্রোঞ্জ পদক বিজয়ী আবেল মুতাই এতে অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতায় পরিষ্কার ফেবারিট ছিলেন এই কেনিয়ান।
সবার ধারণা সত্যি করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে ছিলেন মুতাই। ক্রস কান্ট্রি রেসে যেমনটা হয়, দৌড়ের শেষ দশ মিটার ট্র্যাকের বাইরে একটু আলাদাভাবে সবুজ গালিচার মধ্যে থাকে। ফিনিশিং লাইনের ১০ মিটার এই ঘেরাও অংশটাতে দৌড়াতে হয়। এখানে এসেই বিভ্রান্ত হলেন মুতাই। চার পাশে এমন ঘেরাও অংশ দেখে মুতাই দৌড়ের গতি থামিয়ে দিলেন। হেঁটে হেঁটে এগোতে লাগলেন মুতাই। ফিনিশিং লাইনেও আয়োজকদের কাউকে না অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে আসতে না দেখে কিছুটা দ্বিধায় ভুগছিলেন।
পেছন থেকে এতক্ষণ তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলেন স্পেনের ইভান ফার্নান্দেজ আনায়া। মুতাইয়ের এভাবে থেমে যাওয়ায় সুবিধা হলো তাঁর। ধরেই ফেললেন মুতাইকে। কিন্তু যখনই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হলো তখন মুতাইয়ের চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনার জন্ম দিলেন আনায়া। চিৎকার করে ডাকলেন মুতাইকে। ততক্ষণে ট্র্যাকের পাশে দাঁড়ানো দর্শক চিৎকার করে কেনিয়ানকে দৌড় শেষ করার কথা বলছিলেন। আনায়াও বললেন দৌড় শেষ কর, এখনো পথ বাকি। কিন্তু স্প্যানিশ না বোঝা মুতাই বুঝতে পারছিলেন না কিছুই। উপায় না দেখে আনায়া তখন তাকে ইঙ্গিত দিয়ে এগিয়ে যেতে বললেন। তাতেও কাজ হচ্ছিল না। ফল প্রায় ঠেলে ঠেলেই তাঁকে ফিনিশিং লাইন পার করিয়ে দিলেন আনায়া।
কেন নিশ্চিত জয় হাতছাড়া করলেন, সে প্রশ্নের উত্তরে আনায়ার সহজ উত্তর, ‘আমার জেতা উচিত হতো না। আমার যা করা উচিত ছিল, তাই করেছি। ওরই জেতা উচিত ছিল। সে এত এগিয়ে গিয়েছিল যে, ভুল না করলে আমি কোনোভাবেই তার ধারেকাছে যেতে পারতাম না। যখনই দেখলাম সে থেমে গেছে, আমি জানতাম আমি তাকে পাশ কাটিয়ে এগোব না।’
এ কাণ্ডের পর তাঁর কোচ ফিজ বলেছিলেন, ‘সে চাপ নিতে জানে না। এটাই চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য গড়ে দেয়। যদি সে এটা পারত তবে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে থাকত।’ ফিজের কথা খুব একটা মিথ্যা হয়নি। ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের স্পেন দলে জায়গা করে নিলেও বর্তমানে ৩২ বছর বয়সী ফার্নান্দেজ আনায়া কখনো অলিম্পিকে দৌড়াতে পারেননি। কোনো ধরনের প্রতিযোগিতাতেও পদক পাননি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সত্যিকারের একজন মানুষ হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন আনায়া। এমনকি যদি তখন তাঁকে বলা হতো এ দৌড় জিতলে স্পেন দলে জায়গা পেতে আর চার বছর অপেক্ষা করতে হবে না তবুও মুতাইকেই জিততে দিতেন আনায়া।
'বুরলাদা ক্রস কান্ট্রি রেস জেতা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না… শুধু বলতে পারতাম একজন অলিম্পিক পদকজয়ীকে হারিয়েছি। কিন্তু তারা যদি আমাকে বলত এতে আমি ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার জন্য স্পেন দলে ডাক পাব, তবু এটা করতাম না। যদি বিশ্ব বা ইউরোপিয়ান পদকের ব্যাপার হতো তাহলে হয়তো ভিন্ন কিছু হতো। হয়তো তখন আমি জেতার চেষ্টা করতেও পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয় জিতলে যতটা হতো এখন তার চেয়ে বেশি নাম ছড়িয়েছে আমার। এবং এটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন সব খেলায়, ফুটবলে, সমাজে বা রাজনীতিতে যা হচ্ছে, এমন সততার নিদর্শন দেখানো দরকার ছিল।'
যখনকার ঘটনা, তার কদিন আগেই ল্যান্স আর্মস্ট্রংয়ের ডোপ কেলেঙ্কারি ধরা পড়েছে। ক্যানসার বিজয়ী একজনের সাতবার ট্যুর ডি' ফ্রান্স জয়ের রূপকথার মিথ ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্রীড়াজগতে সততা, নিষ্ঠা আর মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। ক্রীড়াবিদদের অর্জন নিয়ে বাঁকা চোখে তাকানো শুরু হয়েছিল। তখন এমন কিছু খুব করে দরকার ছিল ক্রীড়া জগতের। তবু সাংবাদিকদের তৃপ্তি হচ্ছিল না। কেন? কেন একজন দৌড়বিদ যে আগে কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় কোনো অলিম্পিয়ানকে হারানোর সুযোগ হাতছাড়া করবেন?
প্রশ্নটা শুনে বরং অবাক হলেন হার্নান্দেজ আনায়া, ‘এভাবে জিতলে সেটার মূল্য কী থাকত? এ পদক জেতার গৌরব কোথায়? আমার মা কী ভাবত আমার সম্পর্কে?’
ইভান ফার্নান্দেজের মা নিশ্চিত থাকতে পারেন তাঁর সন্তানকে নিয়ে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে যেভাবে সততার নিদর্শন দেখিয়েছিলেন ইভান, ছেলেকে নিয়ে ভাবতে গেলে কখনো দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না তাঁকে।