অভিনব বিন্দ্রার পর অলিম্পিকে ভারতকে প্রথম ব্যক্তিগত সোনা এনে দিলেন নীরজ
অভিনব বিন্দ্রার পর অলিম্পিকে ভারতকে প্রথম ব্যক্তিগত সোনা এনে দিলেন নীরজ

ভারতের অলিম্পিক সাফল্যের নেপথ্যে ‘টপস’

অলিম্পিকে সেরা সাফল্য ভারত পেল এবারই। কীভাবে—সেটিই জানিয়েছেন ভারতের দৈনিক এই সময়–এর ক্রীড়া সম্পাদক।

সদ্য শেষ হওয়া টোকিও অলিম্পিকে ভারতের পারফরম্যান্সের গ্রাফ ছিল উঁচুর দিকে। এর আগে কোনো অলিম্পিকেই ভারত সাতটি পদক পায়নি। কীভাবে সম্ভব হলো? একটু খতিয়ে দেখা যাক।

সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে। জ্যাভেলিনে প্রত্যাশা ছিল নীরজ চোপড়াকে নিয়ে। কিন্তু তিনি যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিশ্বসেরাদের সঙ্গে লড়ে সোনা এনে দেবেন, ভাবেনি দেশ। এর আগে সোনা তো দূরের কথা, কোনো দিন অ্যাথলেটিকসে ব্রোঞ্জও পায়নি ভারত। এর আগে ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে শুটিংয়ে সোনা এনেছিলেন অভিনব বিন্দ্রা, কিন্তু তারপরের দুটি গেমসে, লন্ডন ও রিওতে কোনো ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা আসেনি।

অলিম্পিকে নিজের দ্বিতীয় পদক জিতেছেন পিভি সিন্ধু

এবার জ্যাভেলিনে সোনার পাশাপাশি ভারোত্তোলন ও কুস্তিতে এসেছে রুপা (মীরাবাই চানু ও রবিকুমার দাহিয়া), বক্সিং, ব্যাডমিন্টন ও কুস্তিতে ব্রোঞ্জ (লভলিনা বরগোঁহাই, পিভি সিন্ধু ও বজরঙ্গ পুনিয়া)। সঙ্গে বড় সাফল্য হকিতে জার্মানিকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ। তবে সবার আগে বলতে হবে ২৩ বছর বয়সী নীরজ চোপড়ার কথা। ৭ আগস্ট নীরজের ইভেন্ট জ্যাভেলিন যখন চলছে, গোটা ভারত টিভিতে চোখ রেখে বসে। অথচ তখনই চলছিল ট্রেন্ট ব্রিজে ভারত-ইংল্যান্ড প্রথম টেস্ট। ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে কোনো একটা ইভেন্ট নিয়ে এই উন্মাদনা অলিম্পিকের সময় বারবার দেখা গিয়েছে। এটা অবশ্যই ভারতের মতো দেশের বড় সাফল্য।

পরিকল্পনা সাজিয়েই ৪১ বছর পর অলিম্পিক হকিতে পদক জিতেছে ভারত

খেলাধুলার সর্বোচ্চ মঞ্চ অলিম্পিক। সেখানে চীন, জাপান বা কোরিয়ার মতো দেশগুলোর তুলনায় এখনো অনেক পিছিয়ে উপমহাদেশের দেশগুলো। প্রতিবেশী চীন যেখানে ইউরোপ, আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিয়ে সব খেলাতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া, সেখানে ভাবনা, নীতি বা পরিকাঠামোর দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ভারত। যে দেশের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি ছাড়াচ্ছে, সেখানে মাত্র ৭টি পদক নিয়ে বেশি ফোলানোর মতো কিছু নেই।

তবে আশার কথা এই যে গত বছর দশেক ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অলিম্পিকে যে খেলাগুলো হয়, তার দিকে নজর দিয়েছে। ক্রিকেট নিয়ে নাচানাচি যেকোনো দেশের খেলার মানদণ্ড নির্ধারণে শেষ কথা হতে পারে না, বিশ্বের দরবারে কল্কে পেতে হলে যে অলিম্পিকে ভালো ফল প্রয়োজনীয়, সেটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে আমাদের। তবে ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার।’

ভারোত্তোলক মীরাবাই চানু এবার জিতেছেন রুপা

সেই নীতি অনুসরণ করেই সাফল্য আসছে। অত্যাধুনিক অ্যাস্ট্রো টার্ফ, বিদেশি কোচ ও ক্রমাগত বিশ্বসেরা দলগুলোর সঙ্গে না খেললে যে হকিতে স্রেফ অতীতের গৌরব নিয়ে বাঁচতে হবে, সেটা বুঝেছিল হকি ইন্ডিয়া। দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল হিসেবে অবশেষে হকিতে ব্রোঞ্জ। অথচ সেখানে একসময় প্রবল শক্তিশালী পাকিস্তানের মতো দেশ যোগ্যতা অর্জনই করতে পারেনি।

একটা জিনিস এখানে মনে রাখতে হবে। যেসব ভারতীয় পদক পেয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই কিন্তু সাহায্য করেছে ‘TOPS’ বা টপস প্রকল্প, যার পুরো কথাটি হলো ‘টার্গেট অলিম্পিক পোডিয়াম স্কিম’।

মিলখা সিং, পিটি ঊষাদের পর ভারত পেল এক নীরজকে।

২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার শুরু করেছিল এই প্রকল্প, যাঁর সাহায্য এখন প্রতিশ্রুতিমান অ্যাথলেটরা পেয়ে থাকেন। সরকারের যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া দপ্তর এটির দেখাশোনা করে, যার উদ্দেশ্য হলো, প্রস্তুতিতে যাতে কোথাও কোনো গলদ না থাকে। এলিট অ্যাথলেট আইডেন্টিফিকেশন কমিটি অ্যাথলেটদের চিহ্নিত করে, যাঁদের পদক পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তারপর তাঁদের প্রতি মাসে ভারতীয় টাকায় দেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা। সঙ্গে বিদেশে প্রশিক্ষণের পুরো খরচ। করোনার সময় টোকিওগামী অ্যাথলেটদের নিয়মিত বিদেশেও পাঠানো হয়েছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। এই মুহূর্তে ভারতে শতাধিক অ্যাথলেট এর আওতাভুক্ত, এ ছাড়া ২৫০ জনের বেশি জুনিয়র অ্যাথলেটকে এর আওতায় আনা হয়েছে ২০২৪-এ প্যারিস ও ২০২৮-এ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকের কথা ভেবে।

খুব সংক্ষেপে, ক্রিকেটের বাইরে অলিম্পিকের খেলাগুলোকে যে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, সেই বোধ এসেছে। দেরিতে হলেও এই বোধোদয় খুব জরুরি ছিল। উপমহাদেশের মধ্যে যে দেশ যত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা উপলব্ধি করবে, তত এগোবে সেই দেশের খেলাধুলা।