ব্যাডমিন্টন কোর্টে জীবনের জয়গান

জীবনকে উপভোগ করতে শিখেছেন তারা।
ছবি: প্রথম আলো

ক্রাচে ভর দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন মতিউর রহমান। তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন রাজশাহীর এ যুবক। দুর্ঘটনার পর অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে হয়েছে ডান পা। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন যিনি এক সময়, সেই মতিউর দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে হারিয়ে ফেলেছিলেন জীবনের প্রতি আগ্রহ। সারাক্ষণ কাঁদতেন। হতাশা আর বিষণ্নতা কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁকে। রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার এক কর্মকর্তা তাঁকে যেন দিলেন নতুন পথের দিশা। তাঁর পরামর্শেই ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু করলেন তিনি।

মতিউরের মতো শারীরিকভাবে অসমর্থ এমন অনেক খেলোয়াড় গতকাল জড়ো হয়েছিলেন পল্টনের শহীদ তাজউদ্দিন উডেনফ্লোর জিমনেসিয়ামে। কোনো না কোনো দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে কেউ পা হারিয়েছেন, কেউবা হাত। হুইলচেয়ারে জীবন কাটে তাঁদের। শরীরের প্রতিবন্ধকতা জয় করে তাঁরা সবাই এসেছিলেন জীবনের জয়গান গাইতে। ব্যাডমিন্টন কোর্টে খুঁজে নিয়েছেন জীবনের আনন্দ, জীবনযাপনের প্রেরণা। বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের আয়োজনে জাতীয় প্যারা ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ যেন আনন্দ-উচ্ছলতার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল তাঁদের জন্য। এতে অংশ নেন শারীরিকভাবে অসমর্থ ৬২ জন শাটলার।

ঢাকার অদূরে চিটাগাং রোড থেকে এসেছিলেন একই পরিবারের তিনজন। বাবা আবদুল আওয়াল, ছেলে ইয়ামিন ও মেয়ের জামাই আশরাফ আলী। জন্মগতভাবে খর্বাকৃতি তাঁদের। ব্যাডমিন্টনের টানে ছুটে এসেছেন তিনজনই। ৫০ বছর বয়সী আওয়াল উচ্ছ্বসিত, ‘আমাদের পরিবার খেলাধুলা পছন্দ করে। আমার স্ত্রীও এসেছে। বছরে দু-একটি দিন এ রকম আনন্দে কাটালে ভালো লাগে।’ আওয়ালের ২০ বছর বয়সী ছেলে ইয়ামিন বলছিলেন, ‘বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানে কাজ করি। এরই ফাঁকে ব্যাডমিন্টন খেলি। আমি এখানে আসি মাঝেমধ্যে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেলতে এসেছি, এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিচ্ছে।’

এবারের প্রতিযোগিতায় ৬২ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন নারী শাটলার। এই তিনজনই এসেছেন বাগেরহাটের ফকিরহাট থেকে। নবম শ্রেণির ছাত্রী অর্পা মজুমদার ঢাকায় ব্যাডমিন্টন খেলতে পেরেই খুশি, ‘ঢাকায় ইনডোরে খেলতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’ জাহিদুল ইসলাম ফকিরহাট থেকে ১১ জন শাটলার নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। খেলাপাগল জাহিদুল ইসলাম নিজের পুকুর ভরাট করে ইনডোর বানিয়েছেন, ‘পুকুরে মাছ চাষ করলে নিজে হয়তো কিছু টাকা পেতাম। কিন্তু স্বপ্নের মৃত্যু ঘটত। তাই বড় ভাই শহীদুল ইসলাম আমার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে সমর্থন করেছেন ইনডোর বানাতে সাহায্য করে। সেখানেই আমি খেলা শেখাই ওদের।’

শারীরিকভাবে অসমর্থ্য তাঁরা, কিন্তু চোখ ভরা স্বপ্ন তাদের।

ময়মনসিংহের যুবক শহীদুল ইসলাম ২০০০ সালে গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে এখন আর দাঁড়াতে পারেন না। ঢাকা সিআরপি ও কলকাতায় চিকিৎসা করানোর পর এখন হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। গত কয়েক বছর নিয়মিত শারীরিকভাবে অসমর্থদের নিয়ে আয়োজিত ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট ও ক্যারমে অংশ নেন তিনি। খেলার মধ্যে জীবনের সব হতাশা ভুলতে চান শহীদুল, ‘খেলার মধ্যেই এখন যত আনন্দ পাই। আমরা প্রতিবন্ধী, অনেকে আমাদের সমাজের বোঝা মনে করে। কিন্তু আমরাও দেশকে কিছু দিতে চাই।’

মতিউর বলছিলেন, ‘দুর্ঘটনার পর সুস্থ হলেও বাসা থেকে বের হতাম না। কান্নাকাটি করতাম। নাহিয়ান (নূর নাহিয়ান, হুইলচেয়ার ফাউন্ডেশনের সভাপতি) ভাইয়ের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের খেলায় এখন নিয়মিত অংশ নিচ্ছি। জীবন নিয়ে এখন কোনো হতাশা নয়, খেলার কোর্টে আনন্দ খুঁজে নিতে চাই সব সময়। খেলাধুলার মাধ্যমে হাসতে চাই। জীবন থেকে বিষণ্নতা দূর করতে চাই।’

বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নূর নাহিয়ান বলছিলেন, ‘আমরা এই ছেলেদের ক্রিকেটসহ সব ধরনের খেলাধুলায় সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও ওরা অংশ নেবে।’

প্রথমবার প্যারা ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেবার মাত্র ৩৫ জন শাটলার এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু এবার আগ্রহ বেড়েছে অনেকের মধ্যে। বাংলাদেশ প্যারা ব্যাডমিন্টন কমিটির সভাপতি ও সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এনায়েত উল্লাহ এই আয়োজনে খুশি, ‘আমি সারা দেশে ঘুরে এই প্রতিবন্ধীদের ব্যাডমিন্টন খেলতে উৎসাহ দিচ্ছি। এবার প্রচুর সাড়া পেয়েছি। ভবিষ্যতে এরা প্যারালিম্পিক, প্যারা এশিয়ান গেমসের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলবে, এটাই আমার চাওয়া। প্যারা ব্যাডমিন্টনে ছয়টি ক্যাটাগরি। এর মধ্যে তিনটি ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের ভালো কিছু করা সম্ভব।’

শরীরের অসমর্থতাকে জয় পেরিয়ে এই শাটলাররা দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন ঢাকায়। হতাশাকে পেছনে ফেলে ব্যাডমিন্টন কোর্টে তাঁরা গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান।