হারলে হয়তো এভাবেই হারতে হয়!
বিজয়ী নিজে হাঁটু গেড়ে সম্মান জানাচ্ছেন। গ্যালারি থেকে গর্জন উঠছে ‘উসাইন বোল্ট’, ‘উসাইন বোল্ট’! কে বলবে, খানিক আগেই হয়ে যাওয়া রেসে সবার আগে লাইন পার করে আসা লোকটি বোল্ট নন। কে বলবে, পেশাদার ক্যারিয়ারে গত নয় বছরে এই প্রথম কোনো দৌড়ে তৃতীয় হয়ে শেষ করলেন বোল্ট। নিজের শেষ ব্যক্তিগত দৌড়ে সোনা জিততে ব্যর্থ হয়ে বোল্ট যেন প্রমাণ করলেন, তিনিও মানুষ!
বোল্ট একজন মর্ত্যের মানুষ—এ কথা যে মানতে ইচ্ছে হয় না। একজন মানুষের ক্ষুদ্র এই জীবনে এমন সব কীর্তি কি করা সম্ভব? অলিম্পিকের আট সোনা কিংবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের এগারো সোনার হিসাব ভুলে যান। বোল্টকে বুঝতে চাইলে ট্র্যাকে চোখ ফেলতে হবে, শ্রবণশক্তিকেও একটু বাড়িয়ে নিতে হবে। তাহলেই টের পাওয়া যাবে, ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি সাতজনকে ভুলে বোল্টের নাম শুধু গ্যালারিভরা দর্শকই জপছেন না। বোল্টকে শেষবারের মতো ১০০ মিটারে দৌড়াতে দেখার আবেগে কেঁপে উঠছে ধারাভাষ্যে থাকা ওই ‘আবেগহীন’ লোকজনের গলাও। তারাও নিরপেক্ষতার ব্যূহ ভেঙে আশা করছিলেন, রূপকথার মতো একটা পরিণতি হোক আজ। নিজের শেষ রেসে জয়ী হয়েই ফিরুক ‘বজ্রবিদ্যুৎ’।
মৌসুমের সেরা সময়ে দৌড়েছেন আজ বোল্ট (৯.৯৫ সেকেন্ড)। কিন্তু জীবন যে রূপকথা নয়, এটা প্রমাণ করতেই বোধ হয় আজ আর জেতা হলো না তাঁর। প্রথমে এলোমেলো শুরু, পরে নিজের লম্বা দুই পায়ে ভর করে সব্বাইকে কাটিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া—এটাই তো বোল্টের ট্রেডমার্ক। আজ কেন যেন শেষটা ঠিক খাপে খাপে মিলল না বোল্টের। শুরু থেকেই এগিয়ে থাকা ক্রিস্টিয়ান কোলম্যানকে কোনোভাবেই আর ছাড়াতে পারলেন না। উল্টো শেষে গতি বাড়িয়ে পাশ দিয়ে জিতে গেলেন জাস্টিন গ্যাটলিন (৯.৯২ সেকেন্ড)। সেই গাটলিন, ডোপ নেওয়ার দায়ে দুই দফা নিষিদ্ধ হয়েছিলেন যিনি। ৩৫ বছর বয়সে এসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার পরও যাকে দর্শকের দুয়ো শুনতে হলো আজ।
গ্যাটলিনের ভাগ্য ভালো, আজ বোল্ট ছিলেন স্টেডিয়ামে। কারণ, দুয়োধ্বনি দেওয়া ব্যস্ত লোকগুলোই খানিক পর ব্যস্ত হয়ে পড়ল সর্বকালের সেরা অ্যাথলেটকে। ৬০ হাজার দর্শকের যে হঠাৎই মনে পড়ল, ‘এই শেষ! আর কখনো দেখা যাবে না এই লোকটিকে।’ যিনি অ্যাথলেটিকসকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। ডোপপাপী বিধ্বস্ত হতে বসা অ্যাথলেটিকসের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছিলেন যিনি। যাঁর বজ্রবিদ্যুৎ আলো দেখিয়েছে, মানুষকে অসম্ভবের স্বপ্ন দেখিয়েছে।
অলিম্পিকের সোনা জেতার মুহূর্তে ফিনিশিং লাইনের কাছে হেলে দুলে দৌড়ানো, একেবারে বলেকয়ে ট্র্যাকে নেমে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে দৌড় শেষ করা কিংবা দৌড়ের শেষ ভাগে টান টান উত্তেজনার মুহূর্তেও আশপাশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারার ক্ষমতা—এসবই তো তাঁকে আলাদা করেছিল। নিজের দৌড়ের সঙ্গে দর্শকদের অংশ করে নেওয়া, দৌড়ের আগে–পরে আমুদে সব অঙ্গভঙ্গিতে সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া এটা আরেকটা খেলা মাত্র, বোল্ট যে আনন্দ ফিরিয়ে এনেছিলেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে। মুষ্টিমেয় কোনো মানুষ নয়, দৌড়ের আনন্দটা ছড়িয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে সবখানে।
এসবই করেছেন অবিশ্বাস্য সব কীর্তি দিয়ে। ১০০ ও ২০০ মিটারের বিশ্ব রেকর্ড দুবার ভেঙেছেন। প্রতিবারই এমন হেলাফেলা করে দৌড়েছেন যে কারওরই সন্দেহ নেই, চাইলেই সে রেকর্ড আবারও দুমড়েমুচড়ে দিতে পারতেন। সতীর্থ নেস্টা কার্টারের ডোপ পাপে ‘ট্রিপল ট্রিপল’টি হাতছাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু অলিম্পিকে কোনো স্প্রিন্টারের তো ‘ডাবল ডাবল’ই নেই! তবে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন সেটা। শেষ একক দৌড়ে তাই তৃতীয় হয়েও কোনো আক্ষেপ নেই তাঁর, ‘আমি দুঃখিত যে জয় দিয়ে শেষ করতে পারলাম না। কিন্তু সবাইকে এমন সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ। সব সময়ের মতো অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা ছিল এটি।’
ধন্যবাদ আপনাকে, উসাইন বোল্ট! আপনার কারণেই যে এক প্রজন্ম ভক্ত-দর্শক দম্ভ নিয়ে বলতে পারবে, ‘অবিশ্বাস্য? ধুর, আমি বোল্টকে দেখেছি!’
আরও পড়ুন:
বিদায় ‘ফরএভার ফাস্টেস্ট’