আলফাজউদ্দিন আহমেদের কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে, ‘ভাই, কষ্টের কথাগুলো বললাম। আসলে ফেব্রুয়ারি এলেই এই দিকটি সবার মাথায় আসে। কিন্তু বছরের পর বছর কোনো বদল তো হয় না। ’
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রেডিও, টিভিতে বাংলা ধারাভাষ্যে খেলার গল্পকে মানুষের হৃদয়ের খুব কাছে নিয়ে যাওয়ার গর্ব তাঁর। কিন্তু প্রবীণ ধারাভাষ্যকারের গর্বই বেদনায় রূপ নেয়, যখন আলোচনা গড়ায় এ সময়ের বাংলা ধারাভাষ্যের হাল নিয়ে। টিভিতে বাংলা ধারাভাষ্য শুনলেই টিভির ‘মিউট’ বাটনে কেন চাপ পড়ে সবার আগে, প্রশ্নটার ব্যাখ্যায় আর চাপা থাকে না জমে থাকা ক্ষোভ।
ক্ষোভ হবে না-ইবা কেন! আবদুল হামিদ, মোহাম্মদ শাহজাহানদের হাত ধরে ১৯৬৩ সালের আগস্টে রেডিওতে বাংলায় ধারাভাষ্যের শুরু, এরপর থেকে নব্বই দশক পর্যন্তও টিভিতে-রেডিওতে ধারাভাষ্য বক্স রাঙিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের শেষ প্রজন্মের প্রতিনিধি আলফাজউদ্দিন। নতুন শতাব্দীতে সম্প্রচারের মাধ্যম বেড়েছে, রং লেগেছে মাঠে-খেলায়, শুধু ক্রমেই ফ্যাকাশে হয়ে পড়ছে বাংলা ধারাভাষ্য।
যে যুগে মানুষের হাতে বিনোদনের উৎসের অভাব নেই, বিশ্বের অন্য প্রান্তের খেলা আর সেটির ধারাভাষ্য টিভি ছাড়িয়েও এখন হাতের মুঠোতে-হেডফোনে চলে এসেছে, সে যুগে প্রতিযোগিতায় টেকা তো দূরের কথা, বাংলা ধারাভাষ্য যেন অপ্রাসঙ্গিকই হয়ে পড়ছে। না ধারাভাষ্য প্রাণ ছুঁতে পারে, না মনে ভাসে কোনো ধারাভাষ্যকারের নাম।
আতাউল হক মল্লিক, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, তওফিক আজিজ খান, খোদাবক্স মৃধা, মোহাম্মদ মুসা, নিখিল রঞ্জন দাস. . . বাংলা ধারাভাষ্যকারের নাম বলতে গেলে হয়তো গত শতাব্দীর শেষভাগ রাঙানো এ নামগুলোই মাথায় আসবে বারবার। বিচিত্র ঢঙের কারণে চৌধুরী জাফরউল্লাহ শরাফতের নামও আসতে পারে। এরপর? শূন্যতা! ধারাভাষ্য আছে, তাতে প্রাণ নেই।
ধারাভাষ্যে যে স্বকীয়তাও নেই! ভাষা তার নিজস্ব ঢঙে এগোয় ঠিকই, তাতে বদল আসে নিয়মিত, এক ভাষার শব্দের অন্য ভাষায় মিশে যাওয়া যুগেরই প্রয়োজন। কিন্তু ধারাভাষ্যে অপ্রয়োজন ইংরেজির ব্যবহার কি বিরক্তি জাগায় না?
আমাদের তো বিসিবি, বাফুফেও চায়না। রেডিওগুলোই যা কিছু করে। আরেকটা সরকারি সংগঠন আছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। বসেই থাকে, কিছু করে নাআলফাজউদ্দিন আহমেদ, ধারাভাষ্যকার
আলফাজউদ্দিনের বিরক্তি জাগায় অপ্রয়োজনে বিশেষণের ব্যবহার কিংবা অতিব্যবহারও। কানে বাধে হাস্যকর ভুলগুলো। জ্ঞানের অভাব? আলফাজউদ্দিনের তা-ই মনে হয়, ‘দেখেন, আমরা যারা ছিলাম, হামিদ ভাই, তওফিক আজিজ ভাই, খোদাবক্স, আমি. . . আমরা কিন্তু সবাই ক্রিকেট-ফুটবল-হকিসহ অনেক খেলার মাঠ থেকেই এখানে এসেছি। খেলতেই হবে এমন নয়, কিন্তু খেললে জানাশোনাটা ভালো থাকে। এ যুগে যখন কোনো ধারাভাষ্যকার বলে পুল করে কাভারে চার মেরেছেন কোনো ব্যাটসম্যান, শুনে মনে হয়, কী আর বলা যায়! ’
বলতে পারেন না দর্শক-শ্রোতাও। অভিযোগ জানাবেন? সেটা কোথায়, কে-ইবা শোনে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, কেউ পরোয়া করে?
ধারাভাষ্যেও নোংরা রাজনীতির গুঞ্জন তো কান পাতলেই শোনা যায়। আলফাজউদ্দিন জানালেন, বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি বড় সিরিজেও কোনো ধারাভাষ্যকারকে বেশি সুযোগ দিতে হয়তো কোনো নেতার ফোন যায় বেতার-টিভি চ্যানেলে। ধারাভাষ্যকারের যোগ্যতা? ফোনের সামনে কাঁচুমাচু কর্মকর্তার সে আর বিবেচনায় নেওয়ার সময় কোথায়!
ফল তো চোখের সামনেই। কিছু বলতে না-পারা দর্শক ধারাভাষ্যকারকেই আর কিছু ‘বলা’র সুযোগ দিচ্ছেন না। সহজ উপায়ের প্রতিবাদের জন্য টিভির মিউট বাটন আছে না!
এর পেছনে অবশ্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) মতো সংগঠনকেও ‘আসামি’র তালিকায় তুলছেন আলফাজউদ্দিন। ভারতে সম্প্রচারমাধ্যমে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি, বাংলার মতো ভাষাতেও খেলার ধারাভাষ্য চলার উদাহরণ টেনে বললেন, ‘আমাদের তো বিসিবি, বাফুফেও এটা চায় না। রেডিওগুলোই যা কিছু করে। আরেকটা সরকারি সংগঠন আছে-বাংলাদেশ টেলিভিশন। বসেই থাকে, কিছু করে না। ’
তার দায় মেটাচ্ছে বাংলা ধারাভাষ্য। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ইংরেজি ধারাভাষ্য বুঝতে না-পারা মানুষই বেশি, তবু বাংলা ধারাভাষ্যে মন বাঁধে না। বাংলার অপমানই কি সেটি? বলা চলে! আলফাজউদ্দিনেরও মন কাঁদে, ‘আমার বয়স ৭২। কবরের কাছে চলে এসেছি। যাওয়ার আগে শুধু দেখে যেতে চাইব যাতে বাংলা ভাষাটা তার সম্মান ফিরে পায়। ’
এর পরের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও কি একই হতাশা থাকবে?