‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’—ওয়েব সিরিজে যেমন সেই রেস্তোরাঁয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যিই খেতে যাননি, তেমনি বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়নের সঙ্গেও বিশ্বকবি কখনো জড়িত ছিলেন না। তারপরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে ১১ জুন ফেডারেশন কাপের আয়োজন করে বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়ন। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, কখনো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কখনোবা কিউবার বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার নামে রাগবি ফেডারেশন আয়োজন করেছে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাস্টারদা সূর্যসেনের নামেও ঢাকায় হয়েছে রাগবি প্রতিযোগিতা।
বিচিত্র সব নামে ঘরোয়া টুর্নামেন্টে ব্যস্ত থাকা রাগবির কর্মকর্তারা এবার মন দিয়েছেন আন্তর্জাতিক আয়োজনে। ২০০৬ সালে রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশের মাটিতে প্রায় ১৬ বছর কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা করতে পারেনি বাংলাদেশ। সাংগঠনিক ব্যর্থতা যেমন ছিল, পাশাপাশি ছিল আর্থিক সীমাবদ্ধতাও। সেভাবে ভালো মানের একটা রাগবি জাতীয় দলও গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশের। তবে গতকাল থেকে ঢাকার বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু নেপাল-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাগবি সিরিজ দিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন দেশের রাগবি খেলোয়াড়েরা। এই সিরিজ দিয়ে প্রথমবার দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার যাত্রা শুরু করল বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়ন।
বিশ্বে সব ধরনের খেলার মধ্যে রাগবি যে কতটা জনপ্রিয়, সেটা না বললেও চলে। সারা বিশ্বে রাগবির ভক্ত প্রায় ৪০৫ মিলিয়ন মানুষ। ২২১টি দেশে ১০ মিলিয়ন মানুষের প্রিয় খেলা রাগবি। ২০১৯ সালে সর্বশেষ যে রাগবি বিশ্বকাপ হয়েছে, জাপানের ওই বিশ্বকাপে শুধু টেলিভিশনেই সরাসরি রাগবি দেখেছে ৮৫৭ মিলিয়ন দর্শক। সারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দেখা খেলার তালিকায় যেটা রয়েছে পঞ্চম স্থানে। অথচ বিশ্বের জনপ্রিয় এই খেলাই কিনা বাংলাদেশে তেমন পরিচিত কোনো খেলা নয়!
তবে এসব নিয়ে মোটেও আক্ষেপ নেই বাংলাদেশ জাতীয় রাগবি দলের অধিনায়ক নাদিম মাহমুদের। একদিন ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে যাবে রাগবি, এমনটাই বিশ্বাস নড়াইলের যুবকের।
আর্মি স্টেডিয়ামে নেপালের বিপক্ষে ‘রাগবি সেভেনস’ (সাত খেলোয়াড় নিয়ে গড়া দুই দলের ম্যাচ) ম্যাচে খেলতে গিয়ে হালকা চোট পেয়েছেন বুকে। চোটের জায়গায় বরফ লাগাতে লাগাতে নাদিম বলছিলেন, ‘এমন একটা সময় আসবে, যখন ফুটবলের চেয়েও এ দেশে বেশি জনপ্রিয় হবে রাগবি।’
বাংলাদেশে সব মিলিয়ে রাগবি ক্লাব আছে ১৬টি। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে নিয়মিত রাগবি খেলে ৩৫০ জন । বছরজুড়েই কোনো না কোনো টুর্নামেন্টের আয়োজন করে রাগবি ফেডারেশন ইউনিয়ন। বর্তমান জাতীয় দলের সব খেলোয়াড় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। বাংলাদেশ নৌবাহিনীও রাগবি দল গড়ার পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের আছে রাগবি দল। কিন্তু আবাহনী, মোহামেডান, বসুন্ধরা কিংসের মতো দেশের প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলোকে রাগবিতে দেখতে চান নাদিম, ‘এসব দল রাগবিতে এলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। ভালো খেলোয়াড় বের হবে। রাগবিতে পেশাদারির ছোঁয়া লাগবে। তখন শুধু সার্ভিসেস দলগুলো নয়, সিভিলিয়ান থেকেও খেলোয়াড় আসবে।’
বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলছেন। এরই মধ্যে ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতারে এশিয়ান রাগবি সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু রাগবির বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেন নাদিম, ‘এসব প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলে এশিয়া রাগবি সিরিজ ওয়ানে খেলার সুযোগ পাব আমরা। সেখান থেকে সেরা দুটি দল সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। যদি বিদেশি কোচ, ট্রেনার, ফিজিশিয়ান দিয়ে একটু ভালোভাবে চেষ্টা করে ফেডারেশন, তাহলে আমরাও বিশ্বকাপে খেলতে পারব।’
ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল নাদিমের। কিন্তু ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর রাগবি খেলা শুরু করেন। নিউজিল্যান্ডের কোচ এসে নাদিমের হৃদয়ে তৈরি করে দিয়েছেন রাগবির প্রতি ভালোবাসা, ‘আগে আমি ফুটবল খেলতাম। কিন্তু এখন এলাকায় গিয়ে ফুটবল খেলতেও ভালো লাগে না। বাঁশ কেটে রাগবির গোলবার বানাই। যতটুকু সময় পাই রাগবি খেলি।’
নড়াইলে নিজের একটা রাগবি ক্লাব আছে নাদিমের। ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা নাদিমের ক্লাবে অনেক সহায়তা করেন, ‘মাশরাফি ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি আর আমার বাড়ি একই জায়গায়। ভাই ক্লাবকে অনেক সহযোগিতা করেন। আমার ক্লাবটা এবার বাংলাদেশ গেমসে খেলেছে।’
জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির মতোই নিজের জেলায় সম্মান পান নাদিম, ‘মাশরাফি ভাইও জাতীয় দলের একসময়ের অধিনায়ক। আমিও রাগবির অধিনায়ক। তবে তাঁর খেলাটা বেশি পরিচিত। সে জন্য বেশি লোকে চেনে তাঁকে। এই খেলা যদি টিভিতে বেশি প্রচারিত হতো, আমাদেরও চিনত। তারপরও ভালো লাগে, শহরের যেকোনো জায়গায়, সরকারি দপ্তরে নিজের পরিচয় দিলেই লোকে সম্মান করে।’
ইউরোপে রাগবি দিয়ে বাংলাদেশকে পরিচিত করতে চান নাদিম, ‘রাগবি সেভেনস বিশ্বকাপ সাধারণত ইউরোপেই বেশি আয়োজিত হয়। ইউরোপে ফুটবল, ক্রিকেট দিয়ে ঢোকা সম্ভব নয়। কিন্তু সুযোগ আছে রাগবি দিয়ে দেশকে পরিচিত করার। যদি সেখানে আমরা ভালো করতে পারি, তাহলে অন্তত তারা চিনবে যে বাংলাদেশ নামের একটা দেশ আছে, যারা রাগবিটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে।’