বাংলাদেশের গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ
বাংলাদেশের গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ

তবু থামেননি বাকি-নিয়াজেরা, লড়েছেন অনলাইনের মঞ্চে

তামিম ইকবাল ছক্কা হাঁকালেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে উঠত সমুদ্রের গর্জন। জামাল ভূঁইয়ার পায়ে বল পড়তেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেও নেচে উঠত গ্যালারি।

মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোরে ভলিবলের আন্তর্জাতিক ম্যাচে কিংবা তায়কোয়ান্দো, উশু দেখতে এসে দর্শকেরা শোরগোলে মাতিয়ে রাখতেন পল্টনের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেসিয়াম। ঠিক এক বছর আগেও এগুলো ছিল ক্রীড়াঙ্গনের সাধারণ ছবি।

মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হতেই বদলে যেতে থাকে খেলার মাঠের চিরচেনা দৃশ্যগুলো। খেলাই বন্ধ ছিল বেশ কয়েক মাস। ক্রীড়া স্থাপনাগুলোতে ছিল ভুতুড়ে পরিবেশ। বিরতি দিয়ে অবশ্য এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাঠে নেমেছেন খেলোয়াড়েরা।

তবে এর আগে অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম। শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে করোনায় জনপ্রিয় হওয়া ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমের পথে হেঁটেছেন খেলোয়াড়, সংগঠকেরা।

বাংলাদেশে সবার আগে অনলাইনে শুরু হয়েছে দাবা টুর্নামেন্ট। এরপর একে একে তায়কোয়ান্দো, উশু, কারাতে, ভারোত্তোলন ও শুটিং ফেডারেশন আয়োজন করেছে অনলাইন চ্যাম্পিয়নশিপ।

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে খেলোয়াড়েরা অনলাইনে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন বেশ কিছু ঘরোয়া টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে অনলাইনে।

এ ছাড়া দাবার সর্বোচ্চ সংস্থা ফিদের আয়োজনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদরা। ফিদে, এশিয়ান দাবা ফেডারেশন ছাড়াও ওয়ার্ল্ড ওপেন ও কন্টিনেন্টাল টুর্নামেন্ট হয়েছে অনলাইনে।

নিশানা ভেদে মগ্ন আবদুল্লাহ হেল বাকি

এই প্রতিযোগিতাগুলোতে খেলেছেন বাংলাদেশের দাবাড়ুরা। অনলাইনে হয়েছে দাবা অলিম্পিয়াড, বিশ্ব ক্যাডেট, যুব চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান জুনিয়র অনূর্ধ্ব-২০ টুর্নামেন্ট, সিনিয়রদের ঊর্ধ্ব-৫০ ও ঊর্ধ্ব-৬৫ বছরের টুর্নামেন্ট, এশিয়ান নেশনস কাপ, জয়তু শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট।

নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, মুঠোফোন, ট্যাবে সাদা–কালো বোর্ড খুলে বসেছেন দাবাড়ুরা। সার্বক্ষণিক তাঁদের পর্যবেক্ষণে থেকেছে দুটি ক্যামেরা।

একটি ক্যামেরা থেকেছে সামনের দিকে, অন্যটি পেছনে। এত কিছুর পরও অনেকের বিরুদ্ধে উঠেছে প্রতারণার অভিযোগ। যেটি খেলার স্বাভাবিক ছন্দকে নষ্ট করে দিয়েছে।

গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ এসব নিয়ে বেশ বিরক্ত ছিলেন, ‘অনলাইনে যেভাবে খেলা হয়েছে, তাতে সরাসরি সামনে বসে খেলার মতো খুব একটা উপভোগ্য হয়নি। কারণ, এই সব খেলায় প্রচুর প্রতারণা হয়েছে। এগুলো এত বেশি ছিল যে একটা পর্যায়ে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে আমার কাছে। আসলে এভাবে প্রতারণা করায় খেলার মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে।’

অনলাইনে সাধারণ সময়ের চেয়ে ম্যাচের পরিসর থাকে অনেক কম। দ্রুত চাল দিতে হয়। এর সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টা যথাযথ পর্যবেক্ষণ না হওয়ায় অখ্যাত বা উদীয়মান দাবাড়ু হারিয়ে দিয়েছেন অভিজ্ঞ দাবাড়ুদের।

দাবার আন্তর্জাতিক আরবিটার হারুনুর রশীদের কাছে অনলাইনে টুর্নামেন্ট পরিচালনা করা ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা, ‘এর আগে আমরা কখনো এভাবে অনলাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করিনি। জুম অ্যাপসের অনেক টেকনিক্যাল বিষয় আমাকে শিখতে হয়েছে। দুটি ক্যামেরায় দাবাড়ুদের সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুক বা ইউটিউবে খেলা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার জন্য অভিজ্ঞতাটা ভালোই ছিল।’

সাধারণত কারাতের দুটি ইভেন্ট (কাতা ও কুমি) নিয়ে যেকোনো প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। কিন্তু অনলাইনে শুধু কাতা ইভেন্ট হয়েছে। কাতায় একজন কারাতেকা নিজের শারীরিক কসরতগুলো প্রদর্শন করেন এবং তা দেখে বিচারকেরা চ্যাম্পিয়নশিপ নিষ্পত্তি করেন।

বাংলাদেশের ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার

স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই কাতা ইভেন্টে খেলা হয়েছে অনলাইনে। কারাতে ফেডারেশন মুজিব বর্ষ কারাতে টুর্নামেন্ট আয়োজন করার পর আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ করে দেয় খেলোয়াড়দের। বাংলাদেশ থেকে এশিয়া প্যাসিফিক সিতোরিও অনলাইন কাতা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন খেলোয়াড়েরা।

এশিয়া, ওশেনিয়া, আমেরিকা অঞ্চলের অসংখ্য খেলোয়াড়দের একই সঙ্গে অনলাইনে খেলানোটা বেশ কঠিন ছিল আয়োজকদের জন্য। যে কারণে প্রতিটি দেশের খেলোয়াড়দের ভিডিও স্থানীয় সময়ে রেকর্ড করে অনলাইনের মাধ্যমে আয়োজকদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর সেটা বিচার বিশ্লেষণ করে কয়েক দিন পর নিষ্পত্তি করা হয় পদকের।

বাংলাদেশ থেকে এই প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জেতেন হাসান খান। অনলাইনে প্রথমবার টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে বেশ রোমাঞ্চিত এসএ গেমসে সোনাজয়ী এই কারাতেকা, ‘করোনায় আমাদের সব খেলা বন্ধ ছিল। কিন্তু করোনার সময় শারীরিক কার্যক্রমগুলো সরব থাকলে ইমিউনিটি বাড়াতে সেটা সাহায্য করে। আমরা বাংলাদেশ গেমসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বেশ বিরতি পড়ে যাওয়ায় ফেডারেশন থেকে অনলাইনে টুর্নামেন্টের ঘোষণা এল। এটা একটা ভালো উদ্যোগ ছিল ফেডারেশনের। আমার খুব ভালো লেগেছে।’

অনলাইনে উশু ফেডারেশন প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য বাংলাদেশের চীন দূতাবাস থেকে সব রকমের প্রযুক্তিগত সাহায্য পেয়েছে করোনাকালে। প্রায় ১২ লাখ টাকা মূল্যের কম্পিউটার, ভিডিও এডিটিং প্যানেল, লাইট, ক্যামেরাসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক যন্ত্র পেয়েছে তারা।

কারাতে দম্পত্তি মুন ও অন্তরা

অনলাইনে টুর্নামেন্টের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কোচেস কোর্সের আন্তর্জাতিক সেমিনারেরও আয়োজন করে উশু ফেডারেশন। অনলাইনে জাতীয় ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করে ভারোত্তোলন ফেডারেশন। ভারোত্তোলকেরা যাঁর যাঁর ভেন্যুতে নির্দিষ্ট ওজন শ্রেণিতে ভার তোলেন প্রতিযোগিতার দিনে।

এরপর স্থানীয় বিচারক ও কোচেরা সেটার ভিডিও করে এবং ওই ভারোত্তোলকের ফলাফল লিখে ফেডারেশনে পাঠিয়ে দেন।

ফেডারেশনের বিচারকেরা সবার ফলাফল বিচার–বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করে। ঘরোয়া টুর্নামেন্টের পাশাপাশি অনলাইনে যুব বিশ্বকাপেও অংশ নেন বাংলাদেশের ভারোত্তোলকেরা।

ফেডারেশন কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বের জেরে গত বছর ডিসেম্বরে এসএ গেমসের পর শুটারদের কার্যক্রম বলতে গেলে স্থবিরই ছিল। অবশেষে অনলাইন শুটিং টুর্নামেন্ট দিয়ে স্বস্তি ফেরে আবদুল্লাহ হেল বাকি, শাকিল আহমেদসহ অন্যদের।

শেখ রাসেল আন্তর্জাতিক অনলাইন এয়ার রাইফেল চ্যাম্পিয়নশিপ, ইন্দোনেশিয়া শুটিং ফেডারেশন আয়োজিত অনলাইন টুর্নামেন্ট, সিঙ্গাপুর ওপেন অনলাইন শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ, মিসরে অনলাইন শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ ও পোল্যান্ডের পোলিশ ওপেন কালিবার চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে বেশ কটি পদক জেতেন বাকি, শাকিলেরা।

শেখ রাসেল আন্তর্জাতিক অনলাইন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন। গুলশান শুটিং রেঞ্জে প্রতিযোগিতায় নামেন বাংলাদেশের শুটাররা। জুমের মাধ্যমে যেটা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে ফেসবুকে।

বিশাল বড় পর্দায় দেখানো হয়েছে অন্য দেশের শুটারদের নিশানা ভেদের লড়াই। আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনেই হয়েছে এই প্রতিযোগিতা।

প্রথমবারের মতো এমন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে রোমাঞ্চিত ছিলেন কমনওয়েলথ গেমসে রুপাজয়ী আবদুল্লাহ হেল বাকি, ‘আমি এখানে আসল প্রতিযোগিতার মতোই আবহ পেয়েছি। অনেক দিনের বিরতির পর টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে বেশ ভালো লেগেছিল।’