কে জানত এভাবে প্রিয় দাদুকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে? কে জানত আরাধ্য পদকটা তাঁর গলায় উঠবে এমন একটা সময়ে! বাংলাদেশ পুলিশের তিরন্দাজ অসীম কুমার দাসের মনের মধ্যে তখন চলছিল শোকের মাতম। পদকমঞ্চে উঠেও তাই চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি কুড়িগ্রামের যুবক।
টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে কাল শেষ হয়েছে বাংলাদেশ গেমসের আর্চারি প্রতিযোগিতা। প্রথমবারের মতো জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনার পদক জিতেছেন অসীম। ছেলেদের কম্পাউন্ড বিভাগের এককে বিজিবির নেওয়াজ আহমেদকে হারিয়েছেন ১৪৮-১৪১ পয়েন্টে ব্যবধানে।
এর আগে র্যাঙ্কিং রাউন্ডে গেমসের রেকর্ড গড়ে স্কোর করেন সর্বোচ্চ ৭০৪ পয়েন্ট। এত এত কীর্তি এক বাংলাদেশ গেমসে, অথচ আনন্দের বদলে অসীমের মনের মধ্যে তখন শুধুই বেদনার ঝড়।
পরিবারের কেউ কখনো খেলাধুলার সঙ্গে জড়িয়ে নেই। তবে দাদু অক্ষয় কুমার দাস একসময় ফুটবল খেলতেন। তাই যখনই আর্চারি খেলার জন্য পরিবার থেকে অনুমতি চাইতেন, অন্যরা ‘না’ করলেও দাদুর সমর্থন পেতেন। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা শেষে যখন বাড়িতে ফিরতেন, অন্যরা সেভাবে খেলার খোঁজখবরই নিতেন না। কিন্তু প্রিয় নাতিকে কাছে ডেকে অক্ষয় কুমার বলতেন, ‘কেমন খেলেছিস?’
যে দাদুর অনুপ্রেরণায় আর্চারি খেলতে এসেছেন, ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আনন্দের দিনে তিনিই পাশে নেই। ২ এপ্রিল বাংলাদেশ গেমসে আর্চারি শুরুর দিনে পেয়েছেন দাদুকে হারানোর দুঃসংবাদ। শেষকৃত্যে যোগ দিতেও যাননি। অবশেষে আরাধ্য সোনা জিতে পদকটি তাঁকেই উৎসর্গ করেছেন।
২০১৫ সাল থেকে আর্চারি খেলছেন অসীম। কিন্তু কখনো এককের ফাইনালেই ওঠেননি। এবার শুধু ফাইনালেই উঠলেন না, সবাইকে চমক দিয়ে জিতেছেন সোনার পদক।
দাদুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছিলেন, ‘আমরা একান্নবর্তী পরিবার। দাদুকে হারিয়ে খুব খারাপ লেগেছে। তবে খেলা শুরু হলেও কাউকে এই মৃত্যুর খবরটা জানাইনি। আমাকে ব্রত পালন করতে হয়েছে। অন্য আনুষ্ঠানিকতা করতে হয়েছে। নিরামিষ খেয়েছি। কিন্তু কষ্ট হলেও চেয়েছি এবার দাদুর জন্য কিছু একটা করতে। শেষ পর্যন্ত সোনা জিতেছি বলে ভালো লাগছে।’
১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাবার মৃত্যুশোক কাটিয়ে পরদিন ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি করেছিলেন। সেই ঘটনা অসীমকে সোনা জিততে অনুপ্রেরণা জোগায়, ‘ফাইনালের আগে শচীন টেন্ডুলকারের কথা বারবার মনে হচ্ছিল। তিনি বাবার জন্য সেদিন সেঞ্চুরি করেছিলেন। ফাইনালে সোনা জিতে আমিও আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।’
অসীমদের বাড়ির পাশেই ভারতের সীমান্ত। দূরদর্শনে নিয়মিত খেলা দেখতেন একসময়। বিশ্বকাপে সোনাজয়ী ভারতীয় তিরন্দাজ দীপিকা কুমারীর খেলা দেখে আর্চারিতে আসার আগ্রহ জাগে। কিন্তু কোথায় বাংলাদেশে আর্চারি খেলাটার চর্চা হয়, সেটা জানতেন না।
২০১২ সালে ফেডারেশন থেকে আর্চারি প্রতিভা বাছাইয়ের ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে ট্রায়ালের পর প্রতিবছর নিজের টাকায় কেনা বাঁশের তৈরি ধনুক দিয়ে অনুশীলন করে ঢাকায় এসে জাতীয় পর্যায়ে খেলে যেতেন। একপর্যায়ে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে তিরন্দাজ ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। এরপর জাতীয় দলের হয়ে দেশ-বিদেশে খেলেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। ২০১৯ কাঠমান্ডু এসএ গেমসে কম্পাউন্ড দলগত ইভেন্টে বাংলাদেশের সোনা জেতায় বড় অবদান ছিল অসীমের।
কৃষক বাবার ছেলে অসীম। খেলেই পরিবারকে সাহায্য করতে চান। সবাইকে সুখী করতে চান। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চাকরিতে সুযোগ পাননি তিনি, ‘আমার সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ অনেক সংস্থায় বলেও কোনো চাকরির সুযোগ পেলাম না। খেলাধুলা করে অনেকেই তো চাকরি পাচ্ছেন। কিন্তু আমার কিছু হলো না, এসব ভেবে খুব খারাপ লাগে।’
অবশ্য বাংলাদেশ পুলিশ অন্যান্য খেলার পাশাপাশি এবার আর্চারি দল গড়েছে। নতুন দলে চুক্তিভিত্তিক খেলছেন অসীম। আশায় আছেন পুলিশের একটা স্থায়ী চাকরি হবে, ‘স্যারেরা যদি আমার পারফরম্যান্স বিবেচনা করে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতেন, তাহলে ভবিষ্যতে নিশ্চিন্তে খেলতে পারতাম। আমার সাফল্যের ধারাবাহিকতাও থাকত।’
নিজের তির-ধনুকের আকাশটা আরও অসীমে ছাড়িয়ে দিতে চান অসীম। লাল–সবুজের জার্সি পরে দেশকে তুলে ধরতে চান আরও উঁচুতে, ‘আর্থিক নিরাপত্তার ব্যাপারটা যদি না ভাবতে হতো, আরও বেশি ভালো খেলতে পারতাম। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে সোনার পদক পাওয়া শুরু। এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চাই এই সাফল্য ধরে রাখতে।’