ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলোতেও আছেন অনেক বড় তারকা। সাফল্যের আলো জ্বেলেই নিজেদের অঙ্গনে আলোকিত তাঁরা। ছোট খেলার সেই সব বড় তারকাদের নিয়েই আজ থেকে এই ধারাবাহিক। প্রথম পর্বে থাকছে টেবিল টেনিস খেলোয়াড় মানস চৌধুরীর তারকা হয়ে ওঠার গল্প—
'অলরাউন্ডার' উপাধিটা দারুণ মানায় মানস চৌধুরীর বেলায়। কখনো দাপটে খেলছেন টেবিল টেনিস। কখনো গান গেয়ে মঞ্চ মাতাচ্ছেন। কখনো গভীর মনোযোগে রোগীর চিকিৎসা করছেন। মানস যেন একের ভেতর তিন!
৪৩ বছর বয়সেও টেবিল টেনিসের টেবিলে ঝড় তোলেন। খেলাটা মানসের কাছে নেশা হলেও পেশা হিসেবে নিতে পারেননি টিটিকে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটি সম্ভবও নয়। ক্যারিয়ার গড়েছেন দন্ত চিকিৎসক হিসেবে।
মানসের বাবা বিখ্যাত গায়ক প্রবাল চৌধুরী। সঙ্গীত শিল্পী উমা খান ও কল্যাণী ঘোষ তাঁর পিসি। এমন একটি সঙ্গীত পরিবারের সন্তান নিজেই গাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গানের চেয়ে মানসকে বেশি টানতো বাড়ির পাশের অগ্রণী সংঘের টিটি বোর্ড। সময় পেলেই কাকাদের সঙ্গে খেলা শুরু করে দিতেন।
কাকা স্বপন চৌধুরীর আগ্রহেই মূলত টিটিতে আসা। কাকা তাঁকে পুরনো একটা ব্যাট উপহার দেন। ১২ বছর বয়সে সেই ব্যাট দিয়েই টেবিল টেনিসে মানসের হাতেখড়ি। চট্টগ্রাম শিশুবাগ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সিনিয়রদের সঙ্গে খেলে নিয়মিত জিততেন মানস। আস্তে আস্তে অংশ নিতে শুরু করেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়।
মানসের প্রতিভা দেখে কোচ রুপম দত্ত তাকে নিয়ে যান চট্টগ্রামের নবীন মেলা ক্লাবে। ক্লাবের সভাপতি জামাল উদ্দিন বাবু খুব স্নেহ করতেন মানসকে। মানস সেখানেও বড়দের হারিয়ে দিতে লাগলেন। খেলার প্রতি মানসের আগ্রহ দেখে তাঁকে ক্লাবের চাবি দিয়ে দেন জামাল উদ্দিন। সেই স্মৃতি মনে করে মানস বলছিলেন, 'আমাকে উনি (জামাল উদ্দিন) খুব স্নেহ করতেন। একদিন ডেকে বলেন এই নাও ক্লাবের চাবি। যখন ইচ্ছা তখন তুমি অনুশীলন করবে।'
১৯৮৮ সালে প্রথম ঢাকায় জাতীয় শিশু একাডেমি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন মানস। এরপর ১৯৯০ সালে অংশ নেন প্রথম জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে। ১৯৯১ সালে হন চ্যাম্পিয়ন।
এ পর্যন্ত জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন পাঁচবার, রানার্সআপ চারবার। ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন চারবার। র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। মাঝে টেনিস এলবোর কারণে খেলতে পারেননি কিছুদিন। চোট সারিয়ে গত জানুয়ারিতে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে উঠেন। বর্তমানে আবারও মানস র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফেডারেশন পাঁচবার লিগের আয়োজন করেছে। সব কটি চ্যাম্পিয়ন দলেই খেলেছেন মানস।
মানস আর্ন্তজাতিক অঙ্গনেও দেশকে সাফল্য এনে দিয়েছেন। এসএ গেমসে এককে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। সার্ক আসিয়ান টিটিতে দলগত ব্রোঞ্জ জেতে বাংলাদেশ, সেই দলেও ছিলেন মানস। বিশ্বকাপ ও বিশ্ব টিটি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছেন পাঁচবার। খেলেছেন গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে। এশিয়ান টিটি চ্যাম্পিয়নশিপে সাত বার ও কমনওয়েলথ টিটি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছেন তিনবার।
সঙ্গিতের আবহে বড় হয়েছেন, তাই গান ছেড়েও থাকতে পারেননি মানস। প্রসঙ্গটা উঠতেই তিনি ফির যান শৈশব–কৈশোরে, 'ছোটো বেলা থেকে বাবা-পিসিদের গান গাওয়া দেখেছি । দেখে দেখে আমিও গাইতে শুরু করলাম...।' ২০০১ সালে প্রথম একক এলবাম বের হয় মানসের। গানের জগতে অবশ্য তিনি রঞ্জন চৌধুরী নামে পরিচিত। রহস্যটা ভেঙে বললেন নিজেই, 'শিল্পী সেলিম খান ছিলেন আমার অ্যালবামের প্রযোজক। তিনি আমার ডাক নামটা পছন্দ করে অ্যালবামে জুড়ে দেন।'
এ পর্যন্ত মানসের একক অ্যালবাম বেরিয়েছে পাঁচটি, মিশ্র ও দ্বৈত অ্যালবাম পঁচিশটি। এছাড়া প্রায় ত্রিশটি সিনেমায় গান গেয়েছেন। গীতিকার কবির বকুলের লেখা প্রথম গানটি ছিল, 'ভালোবাসা বড় কষ্টের....।' সুরকার আলাউদ্দিন আলী। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী মানস।
কিন্তু খেলা বা গান কোনোটাই পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। বাস্তবতা মাথায় রেখেই বলেন, 'জীবিকার প্রয়োজনে ডাক্তার হওয়া। নইলে আমি এটা করতাম না। মনের আনন্দে গান গাই। দেশের বাইরে গেলেই আড্ডায় খুলে বসতে হয় গানের ডালি।'
টেবিল টেনিস ব্যাট হাতে এই বয়সেও যেভাবে খেলছেন, তাতে অনেকেই মানসের ফিটনেস দেখে অবাক হন। খেলার পাশাপাশি ইদানিং কোচিংও করাচ্ছেন। এখন মানসের একটাই স্বপ্ন, নতুন খেলোয়াড় তৈরি করা। 'চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় দলে খেলোয়াড় উঠে আসছে না। যদি একটু জায়গা পেতাম, সেখানে টিটি বোর্ড বসিয়ে কিছু খেলোয়াড় গড়তাম। দেশকে আরও অনেক কিছু দিতে চাই আমি'—বলছিলেন একের ভেতর অনেক মানস চৌধুরী।