জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন দারুণ ক্রীড়াপ্রেমী
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন দারুণ ক্রীড়াপ্রেমী

জাতির পিতার জন্মদিন

একজন ক্রীড়াপ্রেমী রাষ্ট্রনায়কের গল্প

১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মাত্র কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন দেশের মাটিতে। গোটা দেশের এলোমেলো অবস্থা। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা নেই, দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার আগে ব্যাংকের টাকা পুড়িয়ে রেখে গেছে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে খেলার চর্চার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। সীমিত অর্থ ও সম্পদ নিয়ে গোড়াপত্তন করলেন দেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর। গঠন করলেন ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। ক্রীড়া বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল বাংলাদেশ।

আপাদমস্তক ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ছিলেন জাতির পিতা। তিনি খেলার কথা ভুলে থাকেন কীভাবে! নিজেও যে ছিলেন খেলোয়াড়। তাঁর আলোড়ন তোলা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও উঠে এসেছে খেলার প্রতি ভালোবাসার কথা, ‘আমার আব্বাও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম আর আমার টিমের মধ্যে যখন খেলা হতো, তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভালো ছিল। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম। ১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবাই নামকরা খেলোয়াড়।’

যে মানুষটি সেই স্কুলে পড়ার সময় মহকুমার ভালো ভালো খেলোয়াড়দের বেছে নিজের স্কুলে ভর্তি করাতেন, বেতন মওকুফ করিয়ে দিতেন, তিনি রাষ্ট্রনায়ক হয়ে খেলাধুলার প্রতি মন দেবেন, দেশের খেলার উন্নয়নে অবদান রাখবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু দেশ চালানোর। কিন্তু এতটুকু সময়ের মধ্যে দেশের খেলার অগ্রযাত্রার পথটা কিন্তু ঠিকই সুগম করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে ফিফার সদস্যপদ পেয়ে যায় বাংলাদেশ। তিনি দেশের ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের একটা পরিসংখ্যানই বলে দেয়, দেশের খেলাধুলার উন্নয়নে, বিশেষ করে ফুটবলের উন্নয়নে তিনি কতটা যত্নশীল ছিলেন, কতটা আন্তরিক ছিলেন।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনের গোড়াপত্তন তাঁর হাত দিয়েই।

’৭৪ সালে ফিফার সদস্যপদ পেলেও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল কিন্তু ১৯৭৩ সালেই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ফেলে। সে বছরের ২৬ জুলাই কুয়ালালামপুরে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ ২-২ গোলে ড্র করে। কেবল ১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্টের মধ্যেই বাংলাদেশ এশিয়ান প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ১৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল। প্রেক্ষাপটটি চিন্তা করলেই এর বিশেষত্ব অনুধাবন করতে পারবেন যে-কেউই। সদ্য স্বাধীন দেশ, কোষাগারে নেই অর্থ। কিন্তু সীমিত সম্পদ নিয়েও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার প্রয়োজনীয়তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন।

দেশের ক্রীড়াঙ্গন ঋণী বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের কাছে

এখানেই শেষ নয়। দেশের খেলাধুলার অন্যতম সেরা ক্লাব আবাহনী লিমিটেড তো তাঁর পরিবার থেকেই জন্ম নেওয়া। জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালও গড়ে উঠেছিলেন অসম্ভব ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব রূপে। নিজে সারা দিন মাঠেই পড়ে থাকতেন। শুধু কী মাঠ, সংস্কৃতিচর্চায় তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাঁর হাত দিয়ে আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দেশের খেলাধুলায় কত বড় ভূমিকা রেখেছিল, সেটি যেকোনো মানুষই স্বীকার করবেন। এই আবাহনী ৫০ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর বড় পুত্র শেখ কামালের স্মৃতি তাঁর গর্বিত পরম্পরাই বহন করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর সম্মতি, প্রশ্রয় ছাড়া দেশের ক্রীড়াঙ্গনের মহতী এ উদ্যোগ নেওয়া আদৌ সম্ভব হতো না অবশ্যই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশে তো কত সরকারই এসেছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা শেখ কামালের মতো খেলাধুলা প্রসারে যুগান্তকারী এমন একটা উদ্যোগ খুব কমই দেখা গেছে।

খেলোয়াড় বঙ্গবন্ধুর কথাও আমরা সবাই জানি। চল্লিশের দশকে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে তাঁর খেলা ইতিহাসের অংশ। এই ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ঢাকার কলতাবাজারের ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। অল্প দিনের মধ্যেই এটি দেশের জনপ্রিয়তম ক্লাবে পরিণত হয়। ওয়ান্ডারার্সই ১৯৫০, ১৯৫১, ১৯৫৩, ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬ ও ১৯৬০ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগের শিরোপা ঘরে তোলে। বাংলাদেশের ফুটবলে লিগ শিরোপা জয়ের এ রেকর্ড আজও অনন্য। বঙ্গবন্ধু ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেছেন। ১৯৪৩ সালে বগুড়ায় আয়োজিত একটি টুর্নামেন্টে ওয়ান্ডারার্স শিরোপা জিতেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধিনায়কত্বেই। রাজনীতির ব্যস্ততা, দেশের আর্থসামাজিক মুক্তির চিন্তা বঙ্গবন্ধুকে খেলোয়াড়ি জীবন দীর্ঘায়িত করতে দেয়নি। কিন্তু খেলাপ্রেমটা তাঁর রয়ে গিয়েছিল আজীবনই। বাংলাদেশের খেলাধুলার পরম সৌভাগ্য, একজন ক্রীড়াপ্রেমী রাষ্ট্রনায়কের হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল এটির।

বঙ্গবন্ধুর শেষ জন্মদিনে তাঁর গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছেন বড় ছেলে শেখ কামাল।

তাঁর খেলাপ্রেমের একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচ। খেলাটি ছিল রাষ্ট্রপতি একাদশ ও মুজিবনগর একাদশের মধ্যে। তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততার মধ্যেও সে সময়ের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়ে স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন। পুরো খেলা তিনি মাঠে বসে দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাদাম খেতে খেতে ঢাকা স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন, এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক একটা দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু এসব খেলা দেখতে একা যেতেন না, সঙ্গে থাকতেন তাঁর আদরের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। এমনকি জাতির পিতার উৎসাহ দেখে, তাঁর সঙ্গে খেলা দেখতে মাঠে থাকতের মন্ত্রিসভার অন্য সহকর্মীরাও।

নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে আসতে উৎসাহিত করতেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স (যেটি বর্তমানে সুলতানা কামাল জাতীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স)। ১৯৭৩ সালেই ভারতের একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশের নারী ক্রীড়া দল। সে প্রতিযোগিতাতেই লং জাম্প ও ১০০ মিটার স্প্রিন্টে যথাক্রমে রুপা ও ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন তাঁর পুত্রবধূ সুলতানা আহমেদ। শেখ কামাল ভালোবেসে বিয়ে করার পর তাঁর নাম হয় সুলতানা কামাল। তাঁর নামেই ধানমন্ডির সুলতানা কামাল জাতীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের নামকরণ করা হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলার কিছু কুসন্তানের হাতে সপরিবার নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের অনেক স্বপ্নের সঙ্গে সেদিন মৃত্যু হয় বাংলাদেশকে খেলাধুলায় উন্নত এক জাতিতে পরিণত করার স্বপ্নও। মৃত্যু হয় খেলা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘ভিশন’এরও। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই তিনি গণভবনে সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে অংশ নিতে যাওয়া বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের। সেটিই খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছিল তাঁর শেষ দেখা। সেদিন তিনি তাঁদের বলেছিলেন, দেশের জন্য নিজেদের উজাড় করে খেলতে। দেশের জার্সিটাকে পরম আপন ভাবতে। খেলাধুলা দিয়ে খেলোয়াড়েরা বিদেশে দেশকে পরিচিত করছে—জাতির পিতার কাছে এটি ছিল পরম আবেগের এক ব্যাপার।