হাই জাম্পে রেকর্ড গড়েছেন রিতু আক্তার।
হাই জাম্পে রেকর্ড গড়েছেন রিতু আক্তার।

‘আগে যারা কথা বলত না, এখন ডেকে বসতে দেয়’

লাফ শেষ হতেই শুরু হলো সতীর্থদের অভিনন্দন। গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে একের পর এক সাক্ষাৎকার। ব্যস্ততা যেন শেষই হচ্ছে না ঋতু আক্তারের। একপর্যায়ে তো বলেই ফেললেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখি, সত্যিই কি আমি এই রেকর্ডটা গড়েছি!’

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আজ শুরু হয়েছে ৪৪তম জাতীয় অ্যাথলেটিকস। প্রথম দিনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাথলেট ঋতু আক্তার হাই জাম্পে গড়েছেন নতুন জাতীয় রেকর্ড। ১.৭০ মিটার উচ্চতায় লাফিয়ে জিতেছেন জাতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম সোনার পদক।

ঋতুর কীর্তিটা এতটুকু বললেই শেষ হয়ে যায় না। হাই জাম্পের ফেবারিট অ্যাথলেট বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উম্মে হাফসা রুমকির গড়া দুই বছর আগের রেকর্ডটা (১.৬৮ মিটার) তো ভেঙেছেনই, টপকে গেছেন কাঠমান্ডু দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ২০১৯ সালে রুপাজয়ী ভারতের রুবিনা যাদব ও শ্রীলঙ্কার দুলাঞ্জলী রানাসিংহের কীর্তিকেও।

সর্বশেষ এসএ গেমসে ১.৬৯ মিটার উচ্চতায় লাফিয়ে যুগ্মভাবে এই দুই অ্যাথলেট রুপা জেতেন। আর এই ইভেন্টে সোনা জেতেন ভারতের ম্যাথু জিসনা। কেরালার এই অ্যাথলেট ১.৭৩ মিটার উচ্চতায় লাফিয়েছিলেন সেবার।

আজ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেও ১.৭৩ মিটার উচ্চতায় লাফানোর লক্ষ্যে লাফ দিয়েছিলেন ঋতু। কিন্তু লক্ষ্য পূরণ হয়নি ঋতুর। তাতে মোটেও হতাশ নন, ‘ভেবেছিলাম ১.৭৩ মিটার উচ্চতায় লাফ দেব। কিন্তু হলো না। শেষ পর্যন্ত রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছি, এতেই খুশি।’

এক ফ্রেমে নতুন রেকর্ডধারী ঋতু আক্তার ও আগের রেকর্ডধারী উম্মে হাফসা রুমকি।

গাইবান্ধা সদরের পুলিশ লাইনের পাশেই বাড়ি ঋতুর। বাবা হোসেন মিয়া পেশায় সিএনজিচালক। তিন বোনের বাকি দুজন খেলাধুলায় নেই। তবে ঋতুকে পড়াশোনার চেয়ে খেলার মাঠই বেশি টানত। শুরুতে গাইবান্ধায় ক্রিকেট খেলতেন। উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। এই উচ্চতা কাজে লাগিয়ে পেসার হতে চেয়েছিলেন। ক্রিকেট খেলতেন ঢাকায় প্রথম বিভাগ লিগে মিরপুর বয়েজ ও ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের হয়ে।

খেলার সুবাদেই একদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে জুনিয়র অ্যাথলেটিকস দেখতে আসেন। শখ করেই জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে অংশ নেন। প্রথম আসরেই জেতেন সোনার পদক। সেবার লাফিয়েছিলেন ১.৪৫ মিটার। এরপর ২০১৯ সামার জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নেন ঋতু।

বাবা বলতেন, “মেয়ে হয়ে খেলাধুলা কোরো না। মানুষ ভালো বলবে না।”
তাঁর উঠে আসার গল্প বলতে গিয়ে সেনাবাহিনীর অ্যাথলেট রিতু আক্তার

ওই সময় তাঁর উচ্চতা দেখে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সার্ভিসেস সংস্থা তাঁকে অ্যাথলেটিকসে যোগ দিতে প্রস্তাব দেয়। সেই স্বপ্নটা পূরণের সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করেননি ঋতু, ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীর চাকরি করব। প্রস্তাব পেয়ে তাই না করিনি।’

পরিবারের কেউ চাইত না যে ঋতু খেলাধুলা করুক। বাড়ি থেকে পালিয়ে, লুকিয়ে গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে খেলতে যেতেন। ট্র্যাকস্যুট, ট্রাউজার পরে সাইকেল চালিয়ে যেতেন খেলতে। তিনি বলেন, ‘বাবা বলতেন, “মেয়ে হয়ে খেলাধুলা কোরো না। মানুষ ভালো বলবে না।” আমি বাবার কথাও অমান্য করতে পারতাম না। আবার খেলাধুলাও ছাড়তে পারতাম না।পড়শিরা বলত, “মেয়ে হয়ে কেন ছেলেদের পোশাক পরিস?” মা–বাবার কাছে গিয়ে অনেক সময় বাজে সমালোচনাও করত তারা।’ আক্ষেপ করে তিনি আরও বলছিলেন, ‘দাদি আমাকে বলতেন, “তুই মেয়ে মানুষ। খেলতে যাস কেন? যদি হাত–পা ভেঙে যায়, তাহলে তো বিয়ে হবে না।”’

কিন্তু সেই ঋতুকে এখন দেখলে সবাই সম্মান করেন, ‘আগে যারা দেখা হলে কথা বলত না, এখন ডেকে বসতে দেয়। আদর করে। স্নেহ করে। আশপাশের সবাই বলে, দেখো, সেনাবাহিনীর চাকরি পাওয়া ঋতুর বাবা যাচ্ছে। এসব দেখলে খুব ভালো লাগে।’

হাই জাম্পে সোনা জিতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে ঋতুর। আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে বাংলাদেশ গেমস। সেখানে এই উচ্চতা টপকে যেতে চান, ‘আমার এখন আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। বাংলাদেশ গেমসে আরও ভালো ফল করতে চাই।’

যেহেতু এসএ গেমসের রুপাজয়ীদের টপকেছেন, তাই শুধু বাংলাদেশ গেমসই নয়, ঋতুর লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব, ‘যেদিন ট্রায়ালে এই উচ্চতা টপকাই সেদিনই আমার কোচ মেহেদী স্যার বলেছিলেন, “তুমি কি জানো তুমি কী করেছ?” আমি বলি, না স্যার। তখনই স্যার বলেন, “এসএ গেমসেও তুমি সোনা জিততে পারবে।” সেই আশাতেই আমি এখন থেকে অনুশীলন করছি।’

এসএ গেমসে অধরা সোনার পদক জেতার আশায় সামনের দিনগুলোতে আরও কঠোর অনুশীলন করতে চান ঋতু। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে বাজাতে চান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।