তাঁর ঘুম ভাঙে গোলাগুলির শব্দে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রূঢ় বাস্তবতা ভুলতে টেবিল টেনিসে মন সঁপেছেন। কিন্তু সেখানেও শান্তি মেলে না, নিবিষ্ট মনে যে সার্ভ করবে, সে জো নেই। নিরবচ্ছিন্ন গুলি চলছে অদূরে, মাঝে মাঝে বিস্ফোরণের শব্দও ভেসে আসে। এসব মেনে নিয়ে, এসবের মধ্যেই নিজেকে প্রস্তুত করেছেন হেন্দ জাজা।
এমন প্রস্তুতি দিয়ে একেবারে রূপকথা লিখে ফেলেনি। অলিম্পিকে আজ টেবিল টেনিসের প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছেন হেন্দ জাজা। অস্ট্রিয়ার লিউ জিয়ার বিপক্ষে সুবিধা করতে পারেননি, সরাসরি ১১-৪, ১১-৯, ১১-৩, ১১-৫ গেমে হেরে গেছেন। কিন্তু জাজার গল্পটা তো এটুকুই নয়। এ কারণেই প্রথম দিনে বিদায়েও তৃপ্তি সঙ্গী হচ্ছে জাজার।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার মেয়ে হেন্দ জাজা। ‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি!’ কিন্তু সেখান থেকে উঠে আসা সেই জাজাই এবারের অলিম্পিকের সর্বকনিষ্ঠ অ্যাথলেট! মাত্র ১২ বছর বয়সেই ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আয়োজনে নাম লেখাতে পেরেছেন, সেটাও নিজ যোগ্যতায়। সিরিয়া থেকে এ কীর্তিটা কেউ কখনো গড়তে পারেনি টেবিল টেনিসে। সেই জাজা, যার শৈশবের স্মৃতি মানেই গোলাগুলি, বিস্ফোরণ আর স্বজন হারানোর হাহাকার।
আজ কঠিন এক প্রতিপক্ষ পেয়েছিলেন জাজা। ২০০৫ সালে প্রথম ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন লিউ জিয়া। জাজার জন্ম এর চার বছর পর। ১৯৬৮ সালের পর অলিম্পিকে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া জাজা তাই জিয়ার বিপক্ষে খেলতে পেরেই তৃপ্ত, ‘টোকিও অলিম্পিকে আসতে পারাটাই একটা অর্জন। আমাকে জেতার কথা বলা হয়নি, আমাকে বলা হয়েছে ভালো খেলো। আমার ধারণা, আমি ভালোই করেছি এবং এ হার থেকে শিক্ষা নিচ্ছি। আশা করি, পরের অলিম্পিকে আমার জন্য কিছু থাকবে।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় গত ১০ বছরে ৫ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুহারা হয়েছেন এর চেয়েও বেশি। দেশটির অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। সে দেশ থেকেই মাত্র ১১ বছর বয়সে অলিম্পিকের বাছাইপর্ব পার হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। জাজার চোখে ৩৯ বছর বয়সী জিয়ার বিপক্ষে তিনি যা করেছেন, সেটাই অনেক, ‘আমার চোখে আমি কিছু হলেও অর্জন করেছি। একটা ১২ বছরের মেয়ে ৩৯ বছর বয়সীর বিপক্ষে খেলছে এবং ৯ বা ১০ পয়েন্ট নিচ্ছে, এটাই অর্জন। কোনো সন্দেহ নেই, জিততেই চেয়েছিলাম এবং আরও দু-এক ম্যাচ এগোতে চেয়েছিলাম। আশা করি পরের অলিম্পিকে সেটা হবে।’
গতকাল শুক্রবার অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিরিয়ার পতাকা ছিল জাজার হাতেই। দেশে চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতিতে অনুশীলনে অভ্যস্ত জাজার কাছে অলিম্পিকের এই অভিজ্ঞতা একেবারেই অনন্য, ‘সিরিয়ায় যে পরিস্থিতিতে আমি অনুশীলন করি, সেটা অনেক কঠিন। ভিন্ন কোনো কিছু পাওয়ার স্বপ্ন দেখি আমি। আমাদের উঁচু মানের কোনো টেবিল নেই, সেভাবে প্রস্তুতিও নিতে পারি না। আমরা যে খেলতে পারছি, এত বাধা পেরিয়ে এসেছি, এটা বেশ দারুণ ব্যাপার। আমরা দেখাতে চাই, যুদ্ধের মধ্যেও আমাদের কিছু করার আছে।’
১২ বছর বয়সেই অলিম্পিকে অংশ নিয়েছে, কিন্তু জীবন থেকে আরও বড় কিছু চায় জাজা। সেটা শুধু অলিম্পিক পদকে আটকে নেই, ‘আমি খেলা থামাব না। টেবিল টেনিসই আমার জীবন। আমার পুরো সময় খেলার পেছনে ব্যয় করি। টেবিল টেনিসের বাইরে আমি পড়াশোনা করি। আমি ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চাই, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। এরপর আমি ফার্মাসিস্ট বা আইনজীবী হতে চাই। যেদিন অনুশীলন করি না, মনে হয় কী যেন নেই এবং দিনটা ভালো যায় না।’