মুক্তিযুদ্ধে ক্রীড়াঙ্গন

অরুণ নন্দীর ইতিহাস ও একটি আক্ষেপ

বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল ক্রীড়াঙ্গনও। প্রতিবাদের ভাষা ছিল নানা রকম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধে ক্রীড়াঙ্গনের অংশগ্রহণ নিয়েই এই ধারাবাহিক। আজ পড়ুন শেষ পর্ব—

অরুণ নন্দী
অরুণ নন্দী

১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর। সেদিন সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার কলেজ স্কয়ারের গোলদিঘির পানিতে নামেন সাঁতারু অরুণ নন্দী। টানা ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতার কাটেন ২৯ বছর বয়সী চাঁদপুরের এই সাঁতারু। ভেঙে দেন যুক্তরাষ্ট্রের বি সিমুনের ১৯৩২ সালে ৮৯ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট সাঁতার কাটার বিশ্ব রেকর্ড।

কয়েক হাজার দর্শক সেদিন তাঁকে অভিনন্দন জানান। সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার, ব্রজেন দাশের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিরা আসেন আলোচিত সেই সাঁতার দেখতে। মান্না দের গান মাতিয়ে রাখে দর্শকদের। অরুণ নন্দীর প্রদর্শনী সাঁতার থেকে ওঠা অর্থ জমা দেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে। ২০০৮ সালের ১৬ নভেম্বর অরুণ নন্দী অনন্তলোকে পাড়ি জমালেও তাঁর সেই কীর্তি আজও অম্লান।

কদিন পর কুষ্টিয়ার সাঁতারু কানাইলাল শর্মাও অবিরাম সাঁতার কাটেন ভারতে। ২৩ আগস্ট সকাল ৮টা ৫ মিনিট থেকে তিনি একটানা ৯০ ঘণ্টা ১৯ মিনিট সাঁতার কাটেন বলে প্রচার আছে। সেই কীর্তি তেমন আলোয় আসেনি বলে জীবদ্দশায় আক্ষেপ করতেন ২০১৯ সালে পরলোকে পাড়ি দেওয়া কানাইলাল।

অরুণ নন্দী মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, ‘নির্বাচিত লাইফ সেভাররা ৪-৫ ঘণ্টা পরপর আমাকে তরল খাবার চা, দুধ, পানি পান করিয়েছেন। পানিতে ভেসে সে খাবার গ্রহণ করেছি। ১৪ বার বমি করেছি। বমির সঙ্গে রক্ত বের হয়েছে। কিন্তু আমি সংকল্পে অনড় থাকি। মাঝে মাঝে মাকে ডাকতাম।’ (সূত্র: দুলাল মাহমুদের বই খেলোয়াড়েরা যখন রণাঙ্গনে)।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও ইতিহাসে সেসবের তেমন উল্লেখ নেই। মুক্তির সংগ্রামে অবদান রাখা ক্রীড়াবিদদের স্মৃতিও সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এ নিয়ে আক্ষেপ করলেন সাবেক ফুটবলার ও কোচ গোলাম সারোয়ার টিপু, ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ক্রীড়াবিদদের সঠিক কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। তাঁদের সংখ্যাও আমরা জানি না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্মারক তৈরির জোর দাবি জানাচ্ছি।’

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পাশাপাশি ক্রিকেট এবং অন্যান্য খেলার অনেক ব্যক্তিত্বও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। অনেকে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ক্রীড়াঙ্গনে শহীদের সংখ্যাও অগুনতি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া প্রথম সারির ক্রীড়াবিদের সঠিক কোনো সংখ্যা কোথাও উল্লেখ না থাকলেও অন্তত ১১ জনের নাম জানা যায়। এ তালিকায় আছেন ক্রিকেটার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, পাকিস্তান জাতীয় গেমসে পূর্ব বাংলার পক্ষে সোনাজয়ী একমাত্র পুরুষ অ্যাথলেট (পোল ভোল্টার) এ কে এম মিরাজউদ্দিন, কালা খাঁ হিসেবে পরিচিত ফায়ার সার্ভিসের ফুটবলার মুজিবুর রহমান, মানিকগঞ্জের ফুটবলার–অ্যাথলেট তপন চৌধুরী, নোয়াখালীর ফুটবলার সাহাবউদ্দিন এস্কান্দার ভুলু, ময়মনসিংহের দাবাড়ু মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ প্রমুখ।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারান ওয়ারীর ফুটবলার সারোয়ার, সোহরাওয়ার্দী, কামাল স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবলার বাবুল, হকি খেলোয়াড় শামসুল হক মীরু, মোহাম্মদ মীর, অ্যাথলেট শাহেদ আলী, ক্রিকেটার মিজানুর রহমান, দাবাড়ু কাজী সাদিক হাসান, ক্রীড়া সাংবাদিক আবদুল মান্নান লাড়ু, আজাদ বয়েজ ক্লাবের ক্রীড়া সংগঠক মোশতাক, ধানমন্ডি ক্লাবের ফুটবলার ও সংগঠক খোকন, অ্যাথলেট, ফুটবলার মিজানুর রহমানসহ আরও অনেকেই।

মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদদের তালিকাটাও বেশ লম্বাই। খেলোয়াড়েরা যখন রণাঙ্গনে বইয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বাইরে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এমন ৪৭ জনের নাম আছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফুটবলার মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, শরিফুজ্জামান, মজিদুল ইসলাম মনি, রেফারি আবদুল আজীজ, সংগঠক মনজুর হোসেন মালু, অ্যাথলেট নজরুল ইসলাম রুমি, কুস্তির টাইগার জলিল, হকির হাফিজউল্লাহ, বাস্কেটবলের কাজী কামাল, অ্যাথলেট (হাবিলদার) শামসুল হক প্রমুখ।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে জাতি আজ কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবে তাঁদেরও।