বেলা একটা থেকেই পল্টন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনের সামনে ক্রীড়া সংগঠকদের ভিড়। অনেকের হাতেই ফুলের তোড়া। বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন, ক্রীড়া সংগঠন, ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতারাও এসেছেন ফুল নিয়ে। এত ফুল, ক্রীড়া পরিষদের ছোটখাটো একটা কক্ষই ভরে যেত সব একত্র করলে।
কে কার আগে ফুলের তোড়া দেবে, চলল সেই প্রতিযোগিতা। দেখে মনে হলো, মেসি, রোনালদোদের কেউ বুঝি এসেছেন বাংলাদেশে। নাজমুল হাসান অবশ্য বাংলাদেশের ক্রীড়া সংগঠকদের কাছে এখন ‘মেসি’ পর্যায়েরই। এত দিন ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি। এখন যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রীর মুকুটও তাঁর মাথায়। বহুদিন পর বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন পেল একজন পূর্ণ মন্ত্রী।
মন্ত্রী হিসেবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে (এনএসসি) তাঁর প্রথম আগমন যে একটু আলাদা হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! এনএসসিতে মন্ত্রীর প্রথম আগমন নিয়ে সব সময়ই উচ্ছ্বাসের ঢেউ ওঠে। সংবর্ধনার ঢল নামে। অচেনা ‘দুধের মাছি’ শ্রেণির ক্রীড়া সংগঠকেরাও হঠাৎ উদিত হন এ সময়ে। আজ একটু বেশিই হলেন। বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়ামন্ত্রীকে এমন ফুলেল শুভেচ্ছার ঢেউ অতীতের সব রেকর্ডকেই ছাপিয়ে গেছে।
বিস্তর বিশৃঙ্খলাও তৈরি হয়েছে সে কারণে। দেশের প্রায় ৫০টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা হুড়োহুড়ি করে শুভেচ্ছা জানালেন মন্ত্রীকে। ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন পরিচালকও ছিলেন। এ ছাড়া ফুটবল, হকি, সাঁতারসহ বিভিন্ন ফেডারেশনের কর্মকর্তারা ছিলেন ফুলেল শুভেচ্ছার এই মহামিছিলে।
দুপুরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে যখন ক্রীড়া পরিষদের আটতলায় মন্ত্রী নিজের কক্ষে আসেন, গিজগিজ করছে চারপাশ। স্লোগান উঠল ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’। মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কক্ষে অনেকেই ঢুকে পড়েন স্রোতের মতো। সেখান থেকে মন্ত্রী বেরিয়ে ক্রীড়া পরিষদের পঞ্চম তলায় যান। ক্রীড়া সংগঠকেরা যেখানে অপেক্ষা করছিলেন তাঁকে ফুল দিতে। এই পর্ব ৩০-৪০ মিনিট চলল। ফুল নিতে নিতে মন্ত্রী একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলেন।
সেখান থেকে বেরিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে যান নাজমুল হাসান। মিনিট ত্রিশেক পর আবার এলেন সে কক্ষে। সাংবাদিকেরা বসে আছেন মন্ত্রীর দু-চারটি কথা শোনার জন্য। প্রথম দিনে মন্ত্রীরা সাধারণত যা বলেন, নাজমুল হাসানও তা–ই বলেছেন। তবে তাঁর কথায় কিছু নির্দিষ্ট ইঙ্গিত আছে।
প্রথম পদক্ষেপ কী হবে, সেই প্রশ্নে যেমন বলেন, ‘প্রতিটি খেলাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে সব খেলাই বিশ্বকাপ খেলবে, সেটা আশা করা ঠিক হবে না। আমি মনে করি, প্রথমে আমাদের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। প্রথমে মন্ত্রণালয় সম্পর্কে আমাকে জানতে হবে। মন্ত্রণালয় সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা না হওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারব না কী করণীয়। আমাদের সক্ষমতা কী, সেটাও জানতে হবে।’
মন্ত্রণালয় এবং এ–সম্পর্কিত বিষয়গুলো জানার পর আলাদাভাবে ফেডারেশনগুলোর সঙ্গে বসতে চান তিনি। ফেডারেশনগুলো আর্থিক সমর্থন চাইবে জানা কথা। তবে নাজমুল হাসানও পাল্টা জানতে চাইবেন, কোন ফেডারেশনের কী লক্ষ্য? কোন কোন খেলাকে সমর্থন দিলে কাজ হবে, সেটা আগে বের করতে চান তিনি। কোনো খেলায় সম্ভাবনা দেখলে সমর্থন অব্যাহত রাখবেন। সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন, সবকিছু সরকার করে দেবে, সে আশায় বসে থাকা ঠিক নয়।
আজ যে বিশৃঙ্খলা হলো, এটা আমার ভালো লাগেনি। আগামী দিনে এমন আর হবে না।যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান
ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি হিসেবে নাজমুল হাসানের কিছু অর্জন আছে। এখন ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে কী স্বপ্ন দেখবেন? তৃণমূলে প্রশিক্ষণে জোর দেবেন কি না? এসব প্রশ্নে নাজমুল হাসান বললেন, ‘অনেক সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় আছে। একসময় মনে হয়েছে ফুটবলই একমাত্র খেলা। আস্তে আস্তে ক্রিকেটকে মনে হয়েছে, এটাই বিশ্বপর্যায়ের খেলা।
আমার কথা হচ্ছে, এ রকম আরও খেলা আছে। এগুলোতে ভালো করা সম্ভব।’ তারপর নিজেই প্রশ্ন করেন, ‘এখন ভালো বলতে কী বোঝায়?’ উত্তরও দিলেন নিজেই, ‘কোনোটা বিশ্বকাপে খেলতে চাইতে পারে। কোনোটা এশিয়ান গেমসে, কমনওয়েলথ গেমসও আছে। সব কটিই বিশ্বকাপে খেলবে, এমন ভাবলে ঠিক হবে না।’
ক্রীড়া খাতে সরকারের যা বরাদ্দ, তার বেশির ভাগই যায় অবকাঠামো উন্নয়নে। তবে নতুন মন্ত্রী নাজমুল হাসান ঢালাওভাবে স্টেডিয়াম তৈরির পক্ষে নন বলেই মনে হলো, ‘আমি কিন্তু স্টেডিয়াম বানানোর পক্ষে নই। আমি সব সময় খেলার মাঠের পক্ষে। স্টেডিয়ামের অভাব নেই তা নয়। কিন্তু সব জায়গায় স্টেডিয়াম দরকার নেই। কেন সব জায়গায় স্টেডিয়াম করতে হবে? আমাদের দরকার একটা খেলার মাঠ, তার সঙ্গে ড্রেসিংরুম। একটা অফিস থাকতে পারে।’
স্টেডিয়াম নিয়ে মন্ত্রীর অভিজ্ঞতা যে ভালো নয়, সেটাও বলেছেন, ‘একটা স্টেডিয়াম করার পর দেখি, সেটায় তালা মারা থাকে। এটার মধ্যে তো ঢুকতেই পারবে না কেউ! খেলবে কোথায়? এ রকম হলে স্টেডিয়াম করে তো লাভ নেই।’ এরপর প্রশ্ন তোলেন, ‘স্টেডিয়াম করতে খরচ কত? রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কে দেবে? সব ফেডারেশনের কি সক্ষমতা আছে রক্ষণাবেক্ষণের? এত স্টেডিয়াম রক্ষণাবেক্ষণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।’
নাজমুল হাসান এখন ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আবার ক্রীড়ামন্ত্রীও। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন বিসিবি। এটা সাংঘর্ষিক কি না, প্রশ্ন হয়েছে এ নিয়েও। মন্ত্রী অবশ্য এ বিষয়ে আগে যা বলেছেন, আজও বলেছেন সে কথাই, ‘আপনি যদি মনে করেন সাংঘর্ষিক, তাহলে সাংঘর্ষিক। যদি মনে করেন সাংঘর্ষিক নয়, তাহলে সাংঘর্ষিক নয়। এটাই সহজ কথা। আইনগত কোনো বাধা নেই।’
আইসিসির বিভিন্ন কমিটিতে ক্রীড়ামন্ত্রীর থাকার কথা উল্লেখ করে যোগ করেন, ‘আমার ধারণা, এখন এটা (বিসিবি সভাপতির পদ) ছেড়ে দেওয়া ভালো। অন্য খেলাগুলোকেও এখন আমাকে সমান চোখে দেখতে হবে। বিসিবি সভাপতি হিসেবে যে সময়টা দেওয়ার কথা আমার, সেটা এখন আমি দিতে পারব না। আমার ইচ্ছা হচ্ছে, আমি এটা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসব।’
সে ক্ষেত্রে বিসিবির নতুন সভাপতি ঠিক করবেন পরিচালকেরাই, নাজমুল হাসান জানালেন সে কথাও। এখানে সরকারের বা বাইরের কোনো প্রভাবের সুযোগ নেই বলেও মনে করিয়ে দিয়েছেন।
প্রশ্ন হয়েছে আরও কিছু। নাজমুল হাসান সেসব প্রশ্নে গতানুগতিক উত্তরই দিয়েছেন। তবে শেষে বলেছেন, ‘আজ যে বিশৃঙ্খলা হলো, এটা আমার ভালো লাগেনি। আগামী দিনে এমন আর হবে না।’