টি–টোয়েন্টি যখন প্রথম এল, আমার মনে আছে, মোহাম্মদ আশরাফুল বলেছিলেন, এটা তো আমাদেরই খেলা। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, টেস্ট পারব না, এক দিনের খেলা কিছুটা পারব, কিন্তু সবচেয়ে ভালো পারব টি–টোয়েন্টি। ১০ জন ব্যাটসম্যান। দুই ওভার করে খেলব। হাত খুলে পেটাব। বোলারদের চার ওভারের বেশী বল করতে হবে না। আমাদের কে রুখতে পারবে!
আশরাফুল শুধু নন, আমাদেরও মনে হয়েছিল, টি–টোয়েন্টি আমাদের খেলা। ধৈর্য লাগবে না। আমরা লিফট কিংবা বাসস্টপেজে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, দৌড়ে লিফটে বা বাসে ধাক্কাধাক্কি করে উঠি। আমাদের লেখকেরা কেউ ৬৪ পৃষ্ঠার চেয়ে বড় উপন্যাস লিখতে পারেন না। আসলে গদ্য লেখারই–বা লোক কই। সবাই কবিতা লেখে। কারণ, কবিতা লিখতে পরিশ্রম করতে হয় না, সময় দিতে হয় না। কোনোরকমে দু–চার লাইন লিখে ফেললেই হলো। এমনকি লাইনগুলোর মধ্যে সম্পর্ক না থাকলেও চলে।
যেমন:
রোদ মরে যাচ্ছে
হসপিটালে নাও তাকে
মাছরাঙা ডুব দিল
তুমি আজ কোথায়, সাবরিনা!
কেউ কেউ আরও চালাক। লিখবেন:
রোদ মরে যাচ্ছে
রোদ মরে
রোদ
যাচ্ছে
ম রে…
ম…
রে রে রে
তো এই জাতি যদি ক্রিকেট পারেই, তবে পারবে টি–টোয়েন্টি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, টি–টোয়েন্টিও একটা খেলা, যেখানে কৌশল লাগে, ধৈর্য লাগে, শক্তি লাগে, আগ্রাসী মনোভাব লাগে। খেললাম, খেললাম, না খেললাম চলে গেলাম, এমন খেলা ক্রিকেট নয়। ফুটবলে যখন পেনাল্টি হয়, নিজের দল গোলে দাঁড়ালে মনে হয়, গোলপোস্ট দুটি এত দূরে দূরে কেন! আর নিজের সমর্থিত দল কিক নিতে গেলে মনে হয়, গোল এত ছোট কেন! টি–টোয়েন্টিতে আমরা যখন ব্যাট করি, ৬ মারতে গিয়ে মনে হয়, মাঠ এত বড় কেন? আর ওরা যখন ব্যাট করে, মনে হয়, মাঠ এত ছোট কেন? ব্যাটে লাগলেই ৬ হয়ে যায়। আমরা যখন ফিল্ডিং করি, মনে হয়, হাতে এত তেল কেন! আর ওরা যখন ফিল্ডিং করে, মনে হয়, বেটারা কি ফিল্ডিং করতে ১৩ জনকে নামিয়েছে!
যা–ই হোক, বিশ্বকাপ আসছে। বাংলাদেশ যদি ভালো করে, আমরা এটা উপভোগ করব। ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের নাম ‘বাংলাওয়াশ’ রাখা খুব ভালো হয়েছিল, সার্থক নাম। আমরা একরকম ‘বাংলাওয়াশ’ই হয়েছি, চারটা ম্যাচেই হেরেছি। কিন্তু পরাজয়ে ডরে না বীর। এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে আমরা দেখিয়ে দেব!
শুনুন। এ আমার পাপ। এ তোমার পাপ। ঘরোয়া লিগে আম্পায়ারিংয়ের নামে প্রহসন হয়। সারা দেশে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট নেই। খেলোয়াড়দের একটা ক্যাম্পে একসঙ্গে দীর্ঘদিন রেখে প্রশিক্ষণ দিলেও একটা দারুণ টগবগে দল তৈরি হতে পারত! এশিয়ান কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে শ্রীলঙ্কা কী দল ছিল? আমাদের কাছে হারেনি?
আমি চির আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। এবং তা বিশ্বকাপেই। সাকিব আল হাসান এত দিন একটু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছেন। তিনি স্টেজে মেরে দেবেন।
আচ্ছা, এবার বাজি ধরি, আসুন। কে চ্যাম্পিয়ন হবে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে! আমার বাজি ইংল্যান্ড। আপনার বাজি কি অস্ট্রেলিয়া? ধরে রাখুন। জিততে পারেন। নিউজিল্যান্ডও খারাপ করবে কেন? ফাইনালে যাক। আর পাকিস্তানের সম্ভাবনা সব সময়ই বেশি! তাদের আছে ফাস্ট বোলার আর ভালো ব্যাটসম্যান। ভারত তো সব আসরে চ্যাম্পিয়ন হতেই যায়। এবারও যাবে। সঙ্গেই থাকুন।
কে চ্যাম্পিয়ন হবে না, তার তালিকা করবেন? নামিবিয়া হবে না। আফগানিস্তান একাধিক খেলায় জিতলেও শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হবে বলে বাজি ধরাটা ঝুঁকিপূর্ণ।
আরেকজনের ওপর বাজি ধরতে পারেন। সাকিব আল হাসান। দল হারুক জিতুক, তিনি ভালো খেলবেন। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হবেন। বাজি ধরতে চান। আসুন, ধরি।
কারণ কী? কারণ, সাকিব হলেন জিনিয়াস। আর যখন তাঁকে নিয়ে বিতর্ক হয়, তখনই তিনি ব্যাট আর বল হাতে জবাব দেন। মনে রাখবেন, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে তিনি যখন একটার পর একটা ম্যাচে ভালো করছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছিল হোয়াটসঅ্যাপে বাজিকরদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এখনো তাঁর বিরুদ্ধে বেশ অস্বস্তিকর তর্ক–বিতর্ক হচ্ছে। এর জবাব সাকিব বিশ্বকাপের বড় মঞ্চেই দেবেন।
এইবার লাখ কথার এক কথা। খেলার আসল উদ্দেশ্য জয়–পরাজয় নয়। অংশগ্রহণ। আমাদের ক্রিকেট কর্তারা অংশগ্রহণ করতে যাবেন। কেনাকাটাটা বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে আসবে। ওটা লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ।
আমাদের বিশ্বকাপ অবশ্যই অংশগ্রহণের বিশ্বকাপ। আমরা খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব দেখিয়ে যাব।
বাঙালির বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে। আমার বাড়ির উল্টো দিকে গগনচুম্বী ভবনের চূড়ায় উড়ছে ব্রাজিলের সবুজ–হলুদ পতাকা। তার পাশেই ইয়াব্বড় নীল–সাদা। বিশ্বকাপে কে চ্যাম্পিয়ন হবে? অর্ধেক বাঙালির উত্তর একটাই: আর্জেন্টিনা।
লেগে থাকুন। হতেও পারে।