পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে তাঁর জন্ম ১৯৪৭ সালে। স্বাভাবিকভাবেই কথায় ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার টান। কথা বলার নিজস্ব ধরনের কারণে ক্রীড়াঙ্গনে আলাদা পরিচিতি আছে তাবিউর রহমান পাহলোয়ানের। নামে পাহলোয়ান, কাজেও পাহলোয়ানের মতোই। দুই মেয়াদ মিলিয়ে দীর্ঘ ৪২ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশ কুস্তি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তিনি। দেশের কোনো ক্রীড়া ফেডারেশনের দীর্ঘতম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রেকর্ডই গড়েছেন একসময়ের এই কুস্তিগীর। বয়স চলছে ৭৭, তবু কথার ঝাঁজ কমেনি। দেশে কুস্তির হালচাল আর ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর দীর্ঘ পদচারণ নিয়ে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম
আপনি পাহলোয়ান হলেন কীভাবে?
তাবিউর রহমান: প্রথমে বলি, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ পুরান ঢাকায় যে সর্দার প্রথা চালু করেছিলেন, সেই ১০ জনের একজন ছিলেন আমার বাবা মজিবর রহমান মিয়া সরদার। ঢাকায় নগর ভবন জাদুঘরে বাবার ছবি আছে। ১০৭ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। আমি বাবার মতো সর্দার হইনি, হয়ে গেছি পাহলোয়ান। পুরান ঢাকায় আমার এলাকায় শাহাবুদ্দিন নামের এক পাহলোয়ানের ডেরায় যেতাম, তাঁর কাছে গিয়ে কুস্তি শিখতাম। এরপর আমি কুস্তিগীর হয়ে যাই। নামও হয়ে যায় পাহলোয়ান। তবে ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল ব্যবসা-ট্যাবসা করব, কুস্তিগীর হয়ে যাব ভাবতে পারিনি।
পাহলোয়ান–জীবনের কোনো স্মৃতি?
তাবিউর রহমান: একটা স্মৃতি বেশি মনে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা খসরু তখন কুস্তিগীর। তাঁর ওয়েট ক্যাটাগরি আলাদা ছিল। তবে আমরা একসঙ্গে অনুশীলন করতাম শাহাবুদ্দিন পাহলোয়ানের ডেরাতেই। ছয় বছর আমি পূর্ব পাকিস্তান কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। পাকিস্তান দলের সঙ্গে ১৯৬৭ সালে ইরানে গিয়েছি কুস্তি প্রতিযোগিতায়। তখন আমাদের ক্যাম্প হয়েছিল লাহোরের ফিরোজপুর স্টেডিয়ামের ৬ নম্বর গেটে। কোচ ছিলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত কুস্তিগীর আশরাফ ওস্তাদ। সেখানে একই সঙ্গে অনুশীলন করতেন পাকিস্তানের কুস্তিগীর বশীর পাহলোয়ান, আখতার পাহলোয়ানরা। সেই দিনগুলো কখনো ভোলার নয়।
খেলা ছেড়ে অল্প বয়সেই সংগঠক হয়েছেন। ১৯৭৮ থেকে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ কুস্তি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আপনি। এক–এগারোর সংস্কারে পদ হারান। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে দায়িত্বে ফিরে এখন পর্যন্ত আছেন। এত বছরে দেশের কুস্তির কী উন্নতি করলেন?
তাবিউর রহমান: অনেক উন্নতি হইছে। পাকিস্তান আমলের পর কুস্তি ঝিমায়া পড়ছিল। এটার হাল ধইরা রাখছি আমি। কুস্তি ভালোই চলতেছে। গ্রামেগঞ্জে এখনো কুস্তি হয়। কুস্তি হারায় যায় নাই, কুস্তি বাঁইচা আছে। আগে যেসব জেলা খেলত না, এখন খেলে। ন্যাশনালে ২০-২৫টি জেলা খেলে। ১৫টা ক্লাব খেলে। বাহিনীগুলা খেলে। কুস্তি দল দেশি–বিদেশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতেছে। আগে যেমন হারত, এখন ওই রকম না। আমাদের ছেলেরা এখন ভালো করতেছে। গত ডিসেম্বরেই ম্যানচেস্টার থেকে একটা ব্রোঞ্জ নিয়া আসছে। সেইটা ছিল গ্রেট ব্রিটেন গ্রাঁ প্রি অনূর্ধ্ব-২০ প্রতিযোগিতা। আমরা এসএ গেমসে সোনা হয়তো পাইনি। তবে সব সময়ই রুপা-ব্রোঞ্জ পেয়েছি। আমরা সারা বছরই ট্রেনিং করাই।
ট্রেনিংয়ের কোনো প্রতিফলন আদৌ পড়ে দেশের কুস্তিতে?
তাবিউর রহমান: আমাদের ১৭টা ছেলে ভারতের উত্তর প্রদেশের টাটা একাডেমিতে অনুশীলনে করতে গেছে ২৩ ডিসেম্বরে। তিন মাস থাকবে। সেখানে কুস্তিগীরদের মহিষের দুধ খাওয়ায়। মহিষের দুধ দিয়া ঘি বানাইয়া, সেইটা খাওয়ায়। ভালো কুস্তিগীরদের এসব খাইতে হয়। আমরা তো এখানে মহিষের দুধ পাই না। বাদাম খাওয়াই, দুধ খাওয়াই। টাটা কমপ্লেক্সে এর আগেও আমাদের প্লেয়ার গেছে। ইরানে ছয় মাস আগে পাঠাইছিলাম কয়েকজনকে। ওরা চলে এসেছে। কিরগিজস্তানে ২১ দিন অনুশীলন করেছে জুনিয়র টিমটা।
বেশ, কিন্তু অন্য অনেক খেলা ভালো করলেও বাংলাদেশে পিছিয়ে কেন?
তাবিউর রহমান: অন্য খেলায় কী উন্নতি হয়েছে, তা আমি চোখে দেখতাছি না। আপনি দেখেন, ক্রিকেটের অবস্থা। ওদের কোটি কোটি টাকা আছে। শুটিংয়ের কোটি টাকা আছে। অথচ এশিয়ান গেমসে ফল কেমন দেখেন। গত বছর এশিয়াডের আগে অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনকে বলেছিলাম, এসব সাধারণ প্র্যাকটিস দিয়া কিছু হইব না, হয়ওনি। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ পাইছে মাত্র দুটি পদক, তা–ও ক্রিকেটে। কুস্তির দুজনকে পাঠাইতে বলছিলাম কিন্তু আমাদের জায়গা হইল না এশিয়ান গেমসে। আমাদের সমস্যা হইলো খেলার কোনো জায়গাই নাই।
কেন নেই?
তাবিউর রহমান: পাকিস্তান আমল থেকে ২০২২ পর্যন্ত আমরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) জিমনেসিয়ামে প্র্যাকটিস করতাম। এখন সেই জিমটা দখল কইরা ফেলছে। জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন তাদের খেলার জিনিসপত্র দিয়া ভরায়া রাখছে। অনেকবার এনএসসির সচিব পর্যায়ে বসা হইল, মন্ত্রণালয়ের সচিব বসল, আমরা বসলাম। তারপরও কোনো সুরাহা হইল না।
এনএসসির জিমনেসিয়াম থেকে আপনাদের কি বের করে দিয়েছে?
তাবিউর রহমান: ২০২২ সালে আমরা যখন কমনওয়েলথ গেমসে গেলাম, তখন জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন জিমনেসিয়াম থেকে আমাদের ম্যাট তুলে ছুড়ে ফেলে। জিমন্যাস্টিকস অভিযোগ করেছিল, আমরা নাকি ওদের জায়গা দখল করছি। আমরা দখল করব কেন। এনএসসি তখন আমাদের বলেছিল, সব ঠিক করে দিচ্ছি। কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি আজ পর্যন্ত। আমাদের আর জায়গা নাই সেখানে। আমরা আজকে ট্রেনিংয়ের জন্য যাই বিজিবিতে। কাল রোলার স্কেটিংয়ে, পরশু হ্যান্ডবলে ধরনা দিই। আমরা যেন যাযাবর।
কী বলছেন? যাযাবর!
তাবিউর রহমান: আমাদের অবস্থা যাযাবরের চেয়ে করুণ। যাযাবরও একটা জায়গায় কয়েক দিন থাকে, তারপর অন্য জায়গায় যায়। আমাদের সেইটাও নাই। অনেকবার চিঠি দিলাম এনএসসিকে, কমপক্ষে আমাদের একটা জায়গা দিতে। ওইখানে তাঁবু লাগায়া ট্রেনিং করব আমরা। তা–ও কোনো জায়গা আজ পর্যন্ত পাই নাই। ১৭ মাস ধরে আমাদের কোনো জায়গা নাই।
২০০৯ থেকে কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। তাঁর সহায়তা কেমন পেয়েছেন?
তাবিউর রহমান: ভালোই পেয়েছি। কিছুদিন আগে তিনি নিজেই চিঠি দেন এনএসসিকে, এনএসসির টাওয়ারে একটু প্র্যাকটিসের জায়গা দিতে। কিন্তু হতাশার বিষয়, কদিন পরই এনএসসি চিঠি দিয়ে ‘না’ বলে দেয়। সে সময় আমাদের সভাপতি আমাকে বলেছিলেন, আসেন, দরকার হলে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর কাছে যাই। অনুশীলনের জায়গা না পাইলে তাঁর কাছে গিয়া ফেডারেশনের তালা–চাবি বুঝাইয়া দিয়া আসি। কিন্তু বিদায়ী মন্ত্রীর কাছে আমাদের আর যাওয়া হয়নি। এখন নতুন মন্ত্রী এসেছেন, তাঁর কাছে গিয়ে দুঃখের কথা বলব। প্র্যাকটিসের জন্য জায়গা চাইব।
কোথায় চাইবেন জায়গা?
তাবিউর রহমান: এই যে এনএসসি টাওয়ার হইছে, আমরা জানতাম এটার মধ্যে সব ফেডারেশনের জায়গা হবে। কিন্তু কোনো ফেডারেশনের ভাগ্যে জুটল না জায়গা। ওখানে অফিস–হোটেল দিছে। ফ্লোর খালি পইড়া আছে। অথচ আমাদের দেয় না। আমরা সেখানে আবারও জায়গা চাইব নতুন মন্ত্রীর কাছে। এনএসসির পুরোনো ভবনের জিমনেসিয়ামটা ভেঙে নতুন করে করা হোক। সেখানে দুই–চারটা ফেডারেশন প্র্যাকটিস করতে পারলে ভালো হয়। সারা বছর প্র্যাকটিস করতে পারলে কিছু না কিছু রেজাল্ট আসবে। মাঝেমধ্যে প্র্যাকটিস কইরা কোনো লাভ নাই। এগুলি আমি এনএসসি এবং বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভায় অনেক বলেছি, কিন্তু কাজ হয়নি।
কুস্তির ম্যাট আছে তো আপনাদের?
তাবিউর রহমান: ম্যাট আছে পাঁচটা। একটা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ৩ নম্বর গেটের সিঁড়ির ওপরে ফালায়া রাখছি। রাখার জায়গা নাই। একটা করে আছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির কাছে। একটা ম্যাট রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে, সেটাতে এখন আমরা অনুশীলন করি। এনএসসির এত সিকিউরিটি থাকতে তিন বছর আগে আমাদের এক সেট ম্যাটের অনেক কিছু চুরি হইয়া গেছে এনএসসির জিম থেকে। এসব ম্যাট আমরা ভিক্ষা করে আনছিলাম।
কারা দিয়েছে?
তাবিউর রহমান: ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশনের মিটিংয়ে ডাকা হয় সব দেশকে। আমরা যাই, ম্যাট চাই। গতবার ম্যাট তারা দিছে। কিন্তু চিটাগাং কাস্টমস আটকাইয়া দিছে ম্যাট। কত যে দৌড়াদৌড়ি করছি। অনেক টাকা ট্যাক্স ধরছে। আমি তাদের বললাম, এটা আমাদের জাকাত হিসেবে ফ্রি দিছে। আমরা কি জাকাতও গ্রহণ করারও উপযুক্ত না? আপনারা মেহেরবানি করে কিছু নিয়া ম্যাট ছাড়েন। কিন্তু ছাড়ে নাই। এক বছর পর্যন্ত ম্যাট চিটাগাং পোর্টে পইড়া ছিল। উপায় না দেইখা সেনাবাহিনীকে বলি। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে ম্যাট ছাড়াইয়া এনএসসিতে নিয়া আসে।
কিন্তু তারপরও অনেকে আপনাকে ব্যর্থ বলেন। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
তাবিউর রহমান: আমাকে ব্যর্থ বললে সেটা মানতে রাজি না। যদি আমি ব্যর্থই হতাম, তাইলে কুস্তি এত আগাইল কেমনে। এখন আমাদের আর্থিক সংকট। টাকাপয়সা যা–ই আছে না আছে, এনএসসি হেল্প করছে, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন ট্রেনিংয়ের যে ব্যবস্থা করে, তাতে চলে যায়। কিন্তু জায়গার অভাবই বড় সমস্যা।
সমস্যার সমাধান যখন করতে পারছে না, তখন আর কুস্তি নিয়ে পড়ে আছেন কেন?
তাবিউর রহমান: কিছু ‘বেহায়া’ মানুষ আছে ক্রীড়াঙ্গনে, আমি তাদের একজন। আজকে আমি ছাড়লে কুস্তি বইলা আর বাংলাদেশে কিছুই থাকবে না। আমি গ্রামবাংলার মানুষদের ডাইকা আনতেছি, তাদের কিছু কিছু দিয়া ট্রেনিং করাইতেছি। আসলে ক্রীড়াঙ্গনে আর থাইক্যা কোনো লাভ নাই। ফকিরের বেশে আর না। দেখেন, অনেকে ফেডারেশনে আসে নিবার জন্য। তারপর চলে যায়। ধরেন, ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হইয়া আসছে। কিছুদিন পর আসে না। বলে ধুর মিয়া, কী আছে ওইখানে। আমার কোনো চাওয়া–পাওয়া নাই। আমার আল্লাহর রহমতে অনেক আছে। এখান থেকে খাই না। এখান থেকে খাইলে রক্ত হারাম হয়ে যাবে।
এত বছরে কেমন দেখলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন?
তাবিউর রহমান: দেশ স্বাধীন হইছে ৫৩ বছর হয়ে গেছে। আমরা বড় বড় বুলিই আউড়াইয়া গেছি, অনেক মন্ত্রী আসছে। খালি কথাই বইলা গেছে। অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে অনেকে আসছে, ওনারাও কথা বলেছে। আপনি দেখেন, ওপরের লেবেলের মানুষেরা খালি কথাই বইলা যায়। কাজের বেলায় কিছুই করতাছে না। অন্য অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগে বাড়ছে, কিন্তু স্পোর্টস বাড়ছে না। খালি ক্রিকেটরে তালি দিলে, অভিনন্দন জানাইলে তো হইব না। ক্রিকেটে একেকটা প্লেয়ারের কোটি কোটি টাকা। কিন্তু আমাদের প্লেয়ারদের কোনো কিছুই নাই। শুধু কুস্তি বলে না, অন্য খেলাও দেখেন। কেন খেলতে আসবে! গ্রামের ছেলে–মেয়েদের এক মুঠো খাওয়াই কঠিন। ছেলে–মেয়েরা চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে আছে।
শেষ প্রশ্ন, এই ৭৭ বছর বয়সে জীবন কেমন কাটছে?
তাবিউর রহমান: আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো। আমি সরকারের ঠিকাদার ছিলাম। ঢাকা কারাগার, কাশিমপুর কারাগার, ঢাকা জজ কোর্টের একটা অংশ করেছি আমি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অনেক কাজ করেছি। দুই ছেলে লন্ডনে। এক ছেলে কানাডায়। এখন প্রিমিয়ার ভলিবলে ঢাকা সবুজ ক্লাব নামে একটা দল আছে আমার। পাকিস্তান আমলে আমার দুইটা ফুটবল টিম ছিল। একটা স্টার অব পাকিস্তান, আরেকটা আলম টেক্সটাইল। তবে সারা জীবন আমি কুস্তি নিয়াই ছিলাম। কুস্তি আমার প্রাণ, এটা ছাড়া আর বাঁচুম না।