বিপিএল চিনিয়েছে যাঁদের 

বিপিএলের মতো টুর্নামেন্ট অনেকের জন্যই কিছু করে দেখানোর মঞ্চ। ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগ মানেই বিদেশি ও অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করার সুযোগ। টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং হয় বলে বিশ্বের সামনেও নিজেকে মেলে ধরার হাতছানি। 

‘আমি চাই, প্রতিবছর বিপিএল থেকে অন্তত দুটি করে খেলোয়াড় উঠে আসুক। আমি তো এখন পর্যন্ত (মোহাম্মদ) সাইফউদ্দিন বা মেহেদী (হাসান) ছাড়া কাউকে উঠে আসতে দেখিনি। আট-নয় বছরে এটা হতাশার।’ 

গত বছর এশিয়া কাপের আগে সংবাদ সম্মেলনে আক্ষেপ করে বলেছিলেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক এ ক্রিকেট লিগের এটি নবম আসর। তবে আদতেই এ লিগ কজন স্থানীয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারকে তুলে আনতে পেরেছে, সেটি বড় প্রশ্নই বটে। 

২০১২ সালে প্রথম আসরে ১৭টি উইকেট নেওয়া ইলিয়াস সানি দ্রুতই জায়গা করে নিয়েছিলেন জাতীয় দলে, আন্তর্জাতিক অভিষেকে ৫ উইকেটও নিয়েছিলেন। তবে এই বাঁহাতি স্পিনারের ক্যারিয়ার আটকে গেছে ৭ ম্যাচেই। ২০১৬ সালে ২১ উইকেট নিয়েছিলেন বাঁহাতি পেসার আবু হায়দার। তাঁকেও ডাকা হয় জাতীয় দলে, কিন্তু ১৩ ম্যাচের বেশি খেলতে পারেননি। 

বিপিএল শুরু হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক হয়েছে এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০টি ম্যাচ খেলেছেন আফিফ হোসেন। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আফিফের সঙ্গে সে ম্যাচে এ সংস্করণে অভিষেক হয়েছিল আরও তিনজনের—আরিফুল হক, নাজমুল ইসলাম ও জাকির হাসানের। আরিফুল ও নাজমুল আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগে নিয়মিতই বিপিএলে পারফর্ম করেছিলেন। তবে আরিফুল খেলেছেন ৯টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি, নাজমুল ১৩টি, জাকিরের ক্যারিয়ার থমকে আছে ১ ম্যাচেই। 

আফিফ এবার বিপিএলে সেভাবে ভালো করতে পারেননি

অথচ এই চারজনের মধ্যে অভিষেকের আগে বিপিএলে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলেছিলেন আফিফই। যেবার আন্তর্জাতিক অভিষেক হলো, তার আগে বিপিএলের সর্বশেষ মৌসুমেও একটি ফিফটি ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেননি। 

সাকিব যে দুজনের কথা বলেছিলেন, অভিষেকের আগে বিপিএলে তাঁদের পারফরম্যান্স অবশ্য বলার মতোই ছিল। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলা সাইফউদ্দিনের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক ২০১৭ সালে, তার আগের মৌসুমে বিপিএলে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। আর ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগে মেহেদী নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। দুজন অবশ্য সম্প্রতি জাতীয় দলে অনিয়মিতও হয়ে পড়েছেন। 

বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে বিপিএলে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলে জাতীয় দলে অভিষেকের রেকর্ডটি তাইজুল ইসলামের। ২০১৯ সালে অভিষেকের আগে বিপিএলে ৫৫টি ম্যাচ খেলেছিলেন এ বাঁহাতি স্পিনার, যদিও দীর্ঘ সংস্করণে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্পিনার সীমিত ওভারে নিয়মিত নন মোটেও। 

নাসুম আহমেদ

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলে নিয়মিত মুখ আরেক বাঁহাতি নাসুম আহমেদ অভিষেকের আগে বিপিএলে নজর কেড়েছিলেন আঁটসাঁট বোলিং দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে হিটিং সামর্থ্যের কারণে দলে ডাকা হয়েছিল ওপেনার মুনিম শাহরিয়ারকে, অভিষেকের আগের মৌসুমে যিনি ব্যাটিং করেছিলেন ১৫০-এর ওপর স্ট্রাইক রেটে। যদিও জাতীয় দলে তেমন কিছু করতে পারেননি এই ওপেনার, এবার বিপিএলেও নিষ্প্রভই থেকেছেন। 

এখন পর্যন্ত সর্বশেষ আট আসরে টুর্নামেন্টসেরা ক্রিকেটারদের তালিকা বলে—বিপিএল হয় বিদেশিদের, না হয় সাকিব আল হাসান বা মাহমুদউল্লাহর। সর্বোচ্চ তিনবার টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন সাকিব, একবার মাহমুদউল্লাহ, বাকি চারবার বিদেশি ক্রিকেটাররা। তবে সাকিব বা মাহমুদউল্লাহ যখন এ পুরস্কার পান—আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো তাঁরা অভিজ্ঞ নামই! এবার অবশ্য তালিকায় যুক্ত হতে পারে নতুন কোনো নাম। 

এবার ফাইনালের আগপর্যন্ত সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষ পাঁচজনই বাংলাদেশি, যেখানে আছেন সাকিবও। অবশ্য যেভাবে বিদেশিরা যাওয়া–আসা করেছেন এবার, তাতে কারও এমন তালিকায় না ওঠাটা অবাক করার মতো নয়। এর মধ্যেও নাজমুল হোসেন, রনি তালুকদার বা তৌহিদ হৃদয়দের ব্যাটিং আশা–জাগানিয়াই। তাঁদের মধ্যে নাজমুল তো জাতীয় দলে নিয়মিত, ২০১৫ সালে জাতীয় দলে একটি ম্যাচ খেলেছিলেন রনি। একসময় টি-টোয়েন্টির জন্য তেমন উপযুক্ত মনে করা না হলেও হৃদয়ের যেন নতুন উত্থানই ঘটেছে এবার বিপিএলে, নিশ্চিতভাবেই নির্বাচকদের নজর কাড়ার কথা আন্তর্জাতিক অভিষেকের অপেক্ষায় থাকা এ ডানহাতি ব্যাটসম্যানের। 

আজ ফাইনালে বোলিংয়ে কুমিল্লার অন্যতম ভরসা তানভীর ইসলাম

বোলিংয়ে অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই আছে বোলারদের দাপট। গত আসরের মতো এবারও যেমন শীর্ষ পাঁচ উইকেটশিকারির তালিকায় আছেন বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম। আজকের ফাইনালেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের অন্যতম ভরসার নামই হতে যাচ্ছেন তিনি। 

অবশ্য শুধুই পরিসংখ্যানের বাইরেও বিপিএলের মতো টুর্নামেন্ট অনেকের জন্যই কিছু করে দেখানোর মঞ্চ। ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক লিগ মানেই বিদেশি ও অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করার সুযোগ। টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং হয় বলে বিশ্বের সামনেও নিজেকে মেলে ধরার হাতছানি। 

লম্বা চোট কাটিয়ে ফেরা ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী পেসার তানজিম বিপিএলে খেলছেন এই প্রথম। ফাইনালের আগে ছয় ম্যাচে সুযোগ পেয়েছেন, নিয়েছেন ৮ উইকেট। তেমন হইচই ফেলে দেওয়া পারফরম্যান্স নয়, তবে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারেও যেমন ডেথ ওভারের বোলিংয়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রংপুর রাইডার্সকে হারানোর পর সিলেট স্ট্রাইকার্স অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা তাঁকে নিয়ে যেমন বলেছিলেন, ‘এরা দেশের জন্য সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের জন্য সম্পদ।’

সে সম্পদ বাংলাদেশের কতটা কাজে লাগবে, প্রশ্ন সেটিই।