ইয়ারজান বেগমের গল্পটাও পরিচিত। এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আর দশটা কিশোরীকে যেমন প্রচুর বাধাবিপত্তি পেরিয়ে খেলাধুলা করতে হয়, ইয়ারজানকেও পেরোতে হয়েছে তেমন বাধার দেয়াল। পঞ্চগড় থেকে উঠে এসে সেই ইয়ারজানই এখন আলোচনার মধ্যমণি। নেপালে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতের তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে ‘বীর’ যে সে-ই।
ফাইনালের পর তার খুব করেই মনে পড়ছে বাবার কথা। তিনি বেশ অসুস্থ। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আগে সংসার তিনিই চালাতেন। কিন্তু এখন কাজ করতে পারেন না। দুই মেয়েকে আর স্বামীকে নিয়ে সংসার চালান ইয়ারজানের মা। তিনি এখানে–ওখানে কাজকর্ম করেন। দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতোই অবস্থা ইয়ারজানদের পরিবারের।
এমন অবস্থায় ফুটবলার হতে চাওয়াটা অনেক সাহসের। সেই সাহস অবশ্য ইয়ারজানকে দেখিয়েছেন তার বাবাই, ‘আমি স্কুলে ফুটবল খেলতাম। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আমার অনেক ঝোঁক। বাবা আমাকে সাহায্য করেছেন সব সময়ই। তিনিও চেয়েছেন, আমি যেন ফুটবল খেলতে পারি, আমি যেন আমার শখ মেটাতে পারি।’
কিন্তু গ্রামে সেই শখ মেটাতে চাওয়াও অনেক কঠিন। মানুষজন নানা কথা বলত। বাড়ির মেয়ে ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকে, এ কেমন কথা! নানাজনের নানা বাজে কথায় ইয়ারজানের ফুটবল খেলাই বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। এই সময় ত্রাতা হয়ে আসেন স্থানীয় ফুটবল কোচ আবু তালেব। আবু তালেবের একটা একাডেমি আছে। সেখানে বাচ্চাদের ফুটবল শেখান তিনি। মেয়েদেরও শেখান। ইয়ারজান জানালেন কীভাবে তাকে ফুটবলে এনেছেন আবু তালেব, ‘আবু তালেব আমার কোচ, তিনিই বাবাকে বলে তাঁর একাডেমিতে নিয়ে যান। বাবাও মানা করেননি। তিনি তো চাইতেনই আমি ফুটবলার হই। এই আবু তালেবকে আমি স্যার বলি না, বলি “ভাইয়া”। তিনি আমার ভাই।’
আবু তালেবের কারণেই যে এই পর্যায়ে আসা ইয়ারজান, সেটি স্মরণ করল শ্রদ্ধার সঙ্গেই, ‘তিনি না থাকলে আমি এখানে আসতে পারতাম না। তিনি বলতেন, অনেকেই বাজে কথা বলবে, আমি যেন কান না দিই। ভাইয়া বলতেন, “আমি তোকে ঢাকায় খেলাব। তুই নিশ্চিন্তে খেলে যা”।’
আমি মাত্র শুরু করলাম। যেতে হবে বহুদূর। আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই। রুপনা আপুর (রুপনা চাকমা মেয়েদের জাতীয় দলের এক নম্বর গোলকিপার) মতো খেলতে চাই।ইয়ারজান বেগম, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৬ নারী দলের গোলরক্ষক
বাড়ি থেকে আবু তালেবের একাডেমিটা ছিল একটু দূরেই। অনেক সময় নাকি আসা-যাওয়ার ভাড়াও থাকত না ইয়ারজানের কাছে, ‘আমার কাছে সব সময় টাকা থাকত না। বাবাও দিতে পারতেন না। আবু তালেব ভাইয়াই নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। আমাকে বুট থেকে শুরু করে অন্য সরঞ্জামাদি কিনে দিয়েছেন।’
অনেক বাধা পেরিয়ে এই জায়গায় এসে ইয়ারজানের স্বপ্নটা এখন আরও বিস্তৃত, ‘আমি মাত্র শুরু করলাম। যেতে হবে বহুদূর। আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই। রুপনা আপুর (রুপনা চাকমা মেয়েদের জাতীয় দলের এক নম্বর গোলকিপার) মতো খেলতে চাই। আমি বড় ফুটবলার হতে চাই।’
স্বপ্ন দেখাই যার কাছে বাড়াবাড়ি ছিল, অনেক লড়াই করে সেই স্বপ্ন ছোঁয়া ইয়ারজানের আরও বহুদূর যাওয়াটা হয়তো সময়েরই ব্যাপার।