ফুটবলে এলিট ক্লাস বা অভিজাত শ্রেণি খুবই পরিচিত একটি শব্দবন্ধ। একটি দলের চেয়ে অন্য দলের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতেই সাধারণত ব্যবহার করা হয় এটি। অর্থ, সাফল্য, শক্তি, তারকাখ্যাতি কিংবা মেধাতে এগিয়ে থেকেই এলিট পদবি অর্জন করে ক্লাবগুলো। সংবাদমাধ্যম, বিশ্লেষক এবং ভক্ত–সমর্থকেরাই অলক্ষ্যে বসে ঠিক করে কারা এলিট আর কারা নয়।
অন্য সব ক্ষেত্রের মতো আধুনিক ফুটবলও ব্যাপকভাবে অর্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারকা খেলোয়াড়দের কিনে এনে চটজলদি সাফল্য পেতেই উদ্গ্রীব ক্লাবগুলো। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের ছোঁয়ায় প্রায় দুই দশক ধরে ফুটবলীয় অর্থনীতি আরও বেশি ফুলেফেঁপে উঠেছে। এমনকি একজন খেলোয়াড়ের জন্য ২০–২২ কোটি ইউরো খরচ করতেও বাধছে না ক্লাবগুলোর।
এ পরিস্থিতিতে তথাকথিত ছোট দল বা আন্ডারডগরা আরও বেশি প্রান্তিকে নির্বাসিত হয়েছে এবং ফুটবলের নিজস্ব যে জাদু, তা–ও হারিয়ে গেছে। এরপরও কোনো কোনো দল আকস্মিকভাবে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়। প্রমাণ করার চেষ্টা করে মাঠের বাইরে যতই অসমতা থাকুক, মাঠে শেষ পর্যন্ত ১১ জনের বিপক্ষে ১১ জনকেই খেলতে হয়।
মাঠের বাইরের কোনো কিছুই তাই সাফল্যের শেষ কথা নয়। আর এটিই মূলত ফুটবলের আসল শক্তি। যে শক্তিতে এ মৌসুমে জেগে উঠেছে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, লেভারকুসেন, জিরোনা এবং অ্যাস্টন ভিলার মতো দলগুলো। যারা দেখিয়েছে ফুটবলে অর্থ বা তারকাখ্যাতিই শেষ কথা নয়। অদম্য ইচ্ছা ও জেতার ক্ষুধাই সব বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লিখতে পারে রূপকথার নতুন কোনো গল্প।
ডর্টমুন্ডের সাফল্যই ফুটবলের সৌন্দর্য
গত মৌসুমে বুন্দেসলিগা শিরোপা পুনরুদ্ধারের দ্বারপ্রান্তে ছিল বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। কিন্তু শেষ দিনের নাটকীয়তায় অবিশ্বাস্যভাবে শিরোপা নাগাল হারিয়ে ফেলে তারা। সেই বেদনাই হয়তো আরও শক্তিশালী করে তুলেছে দলটিকে। তবে এবার ঘরোয়া লিগে নয়, ডর্টমুন্ড সাফল্যের রূপরেখা সাজিয়েছে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চকে ঘিরে। ১১ বছর পর আবার নিশ্চিত করেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের টিকিট।
আন্ডারডগ হলেও ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে ডর্টমুন্ড কিন্তু একেবারে আগন্তুক নয়। ১৯৯৭ সালে শিরোপা জেতা দলটি সর্বশেষ ২০১৩ সালে ফাইনালও খেলেছিল। অল–জার্মান ফাইনালে সেবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হার মানতে হয় তাদের। এরপর থেকে ইউরোপে শুধু হতাশাই সঙ্গী হয়েছে তাদের। এবারও বাজির দরে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার সবচেয়ে কম সম্ভাবনাময় দলগুলোর একটি ছিল ডর্টমুন্ড।
এমনকি যে আট দল কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট পেয়েছিল, তাদের মধ্যে সম্ভাবনার দিক থেকে ৬ নম্বরে ছিল জার্মানির ক্লাবটি। আর সেমিফাইনালের তিন এলিটের ভিড়ে বহিরাগত হিসেবেই দেখা হচ্ছিল ডর্টমুন্ডকে। কিন্তু পিএসজির বিপক্ষে সেমিফাইনালের দুই লেগে পাশার দান উল্টে দিয়েছে তারা। কিলিয়ান এমবাপ্পেদের বিপক্ষে দাপুটে খেলে জিতেছে দুই লেগেই। আর এখন তাদের সামনে কেবল একটি বাধা। ফাইনালের সেই বাধা টপকালেই ২৭ বছর পর ফের ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি ঘরে তুলবে তারা।
মৌসুমের শুরুতে ডর্টমুন্ডের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলার কথা হয়তো তাদের অন্ধভক্তরাও ভাবেনি। দলবদলে ক্লাবের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জুড বেলিংহামকে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে বিক্রি করে বড় ধাক্কা খায় তারা। বেলিংহামের কোনো বিকল্পও আনতে পারেনি তারা। যার প্রভাব পড়েছে লিগেও। বর্তমানে পয়েন্ট তালিকার ৫ নম্বরে থেকে লিগ শেষ করার অপেক্ষায় আছে তারা। যেখানে শীর্ষে থাকা লেভারকুসেনের চেয়ে ২৪ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে তারা।
ঘরোয়া লিগে পিছিয়ে পড়লেও ইউরোপে একই ভুল করেনি তারা। ম্যাচ ধরে এগোনোর কৌশল অবলম্বন করে দারুণ সাফল্য পেয়েছে দলটি। মাঠে নিজেদের শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং প্রতিপক্ষের খেলার কৌশল ভন্ডুল করে প্রতিটি ধাপ পেরিয়েছে জার্মানির হলদে পাখিরা। এখন একই রূপরেখা ধরে ফাইনালের বাধা পেরোনোর অপেক্ষা। ডর্টমুন্ড যদি শেষ কাজটি ঠিকঠাক সম্পন্ন করতে পারে, তবে সেটি হবে পেট্রোডলারে পুষ্ট ক্লাবগুলোর প্রতি মোক্ষম এক জবাব। পাশাপাশি এটি হবে ডর্টমুন্ডের সেই পাগল সমর্থকদেরও জয়, যারা সাফল্যের কোনো শর্ত না রেখেই দিনের পর দিন দলের পক্ষে স্লোগান দিয়ে গেছে। এ জয় তো বিদায়ের পথে থাকা ক্লাব কিংবদন্তি মার্কো রিউসেরও, কোনো লোভে নত না হয়ে যিনি রয়ে গেছেন ডর্টমুন্ডের সঙ্গে। আর এমন একটি দলের জয় মানে তো দিন শেষে ফুটবলেরই জয়।
লেভারকুসেন–রূপকথা
এ মৌসুমে লেভারকুসেন যা করেছে, কোনো বিশেষণ বা উপমায় তাঁকে পুরোপুরিভাবে বোঝানো কঠিন। রূপকথা কিংবা কল্পকথাও এতটা নাটকীয় নয়। হয়তো ভবিষ্যতে নতুন কোনো রূপকথা লেখার মানদণ্ড হতে পারে এ মৌসুমের লেভারকুসেন। মৌসুম শুরুর আগে যে দলটির নাম–নিশানা কোথাও ছিল না, তারাই এখন জার্মানির চ্যাম্পিয়ন। অপেক্ষা এখন ইউরোপা লিগ ও জার্মান কাপ জিতে ট্রেবল মিশন সম্পন্ন করার। এটুকু হলেও অবশ্য কথা ছিল না।
কিন্তু ট্রেবল জেতার স্বপ্ন দেখা দলটি এখন পর্যন্ত চলতি মৌসুমে কোনো ম্যাচই যে হারেনি। ইউরোপিয়ান ফুটবলের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা ৪৮ ম্যাচে অপরাজিত আছে জাবি আলোনসোর দল। একজন মানুষের হাত ধরে একটি ক্লাব যে আমূল বদলে যেতে পারে, তার প্রমাণও ক্লাবটি। সাদামাটা একদল খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চটা নিংড়ে নিয়ে কৌশলের জাদুতে লেভারকুসেনকে অজেয় একদলে রূপান্তরিত করেছেন আলোনসো।
তবে লেভারকুসেনে জাবির শুরুটা মোটেই মসৃণ ছিল না। ২০২২–২৩ মৌসুমে যখন তিনি ক্লাবের দায়িত্ব নেন তখন লেভারকুসেন অবনমনের শঙ্কায় রীতিমতো কাঁপছিল। সেখান থেকে দলকে পয়েন্ট তালিকার ছয়ে রেখে শেষ করেন আলোনসো। আর চলতি মৌসুমে বায়ার্নের ১১ বছরের দর্পচূর্ণ করে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলিগা শিরোপা নিশ্চিত করেছে দলটি। দলটির শিরোপা নিশ্চিত করার মুহূর্তটিও ছিল ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। ভেরডার ব্রেমেনের বিপক্ষে ৫–০ গোলে জেতা সেই ম্যাচে খেলা শেষ হওয়ার আগেই মাঠে নেমে পড়েন হাজারো দর্শক। যে কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ বাঁশি বাজাতে হয় রেফারিকে।
লিগ শিরোপা জেতার অবিশ্বাস্য মিশন সম্পন্ন হলেও আলোনসো কিন্তু বলে দিয়েছেন এখনো সব কাজ শেষ হয়নি তাদের। পরবর্তী লক্ষ্য ইউরোপা লিগ এবং জার্মান কাপ জিতে ট্রেবল জয় নিশ্চিত করা। অপরাজিত থেকে সাফল্যের সেই শেষ বিন্দুতে পৌঁছালে অমরত্বের চূড়াটাও ছুঁয়ে ফেলবেন আলোনসো।
জিরোনার ইতিহাস
লা লিগায় লম্বা সময় পর্যন্ত শীর্ষে থেকেই চমকের আভাস দিয়েছিল জিরোনা। মনে হচ্ছিল, লেভারকুসেনের মতো তারাও অবিশ্বাস্য কিছু করে দেখাবে। তবে ৩৮ ম্যাচের দীর্ঘ রেসে ধারাবাহিকতা ধরে রাখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং। সেই চ্যালেঞ্জটাতে শেষ পর্যন্ত উতরাতে পারেনি জিরোনা। রিয়াল মাদ্রিদের দাপুটে ফেরার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি অখ্যাত ক্লাবটি। মাঝমৌসুমে পথ হারিয়ে ধীরে ধীরে শিরোপা রেস থেকে ছিটকে পড়ে তারা। যে লড়াইয়ে তারা চেষ্টা করেও আর ফিরতে পারেনি।
তবে শিরোপা না জিতলেও এ মৌসুমে জিরোনা যা করেছে, তা আরও অনেক দিন অক্ষয় হয়ে থাকবে। মাত্র চতুর্থবারের মতো স্প্যানিশ ফুটবলের শীর্ষ স্তরে খেলতে এসেছিল জিরোনা। এমনকি ১৭ বছর আগেও ৩৬৪টি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে চতুর্থ স্তরে খেলেছিল তারা। কিন্তু সেই অতীতকে মাটিচাপা দিয়ে ৩৪ ম্যাচ শেষে লা লিগার দ্বিতীয় সেরা দল তারা। স্প্যানিশ কোচ মাইকেলের হাত ধরেই মূলত জিরোনার বদলে যাওয়া। সর্বশেষ বার্সেলোনার বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৪–২ গোলের জয় দিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলাও নিশ্চিত করে জিরোনা। তবে জিরোনার পথচলাটা মাত্র শুরু। এই পথে হেঁটে আরও অনেক দূর যেতে চায় তারা।
অ্যাস্টন ভিলার ফেরা
শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও অ্যাস্টন ভিলা কিন্তু একসময়ের ইউরোপ–সেরা দল। ১৯৮১–৮২ মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল তারা। ইংলিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ লিগের শিরোপা জিতেছে ৭ বার। কিন্তু টানা ব্যর্থতায় ফসিলের কান্নায় পরিণত হয়েছিল সেসব গল্প। তবে এ মৌসুমে হারানো সেই গৌরব কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করেছে তারা। লম্বা সময় পর্যন্ত শিরোপাদৌড়ে ছিল উনাই এমেরির দল। বড় কোনো অঘটন না ঘটলে প্রথমবারের মতো বর্তমান সংস্করণের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফেরা শুধু সময়ের ব্যাপার।
চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট পেলেও সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় কিছুটা হলেও মন খারাপ হবে ভিলা পার্কের ক্লাবটির। মৌসুমটা যেভাবে শুরু করেছিল, সেটা অব্যাহত রাখতে পারলে এখন এসে শিরোপার জন্য লড়তে পারত তারা। কিন্তু মাঝের সময়ে ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে ক্লাবটি। যা এখন তালিকার চারে নামিয়ে দিয়েছে তাদের। পাশাপাশি ইউরোপা কনফারেন্স লিগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে অলিম্পিয়াকোসের কাছে ৪–২ গোলের হারও বড় ধাক্কা দিয়েছে ক্লাবটিকে। এরপরও এ মৌসুমে যেটুকু অর্জন, তা–ও মোটেই ফেলনা নয়। কে জানে এখান থেকেই হয়তো নতুন দিনের সূচনা করবে ঐতিহ্যের কঙ্কালের পরিণত হওয়া এই ক্লাবটি।