কখনো কখনো রাত নেমে আসে চোখের পাতায় ঘুমের আড়িতে। ফুটবলের মোহে রাত জাগতে জাগতে পোড়া চোখ দুটোও যেন বুঝে যায়, এমন রাতে চোখের পাতায় কপাট দিলে রূপকথার গল্পেরা ধরা দেবে না মনের মুকুরে। বুড়ো বয়সে নাতিপুতির কাছে গল্পের খোরাক হারাতে হবে। এ এমনই অনন্য এক রাত!
ফুটবলপ্রেমীরা কথাটা শুনে খুশি হয়েও বলতে পারেন, এমন রাত আগেও এসেছে। ভবিষ্যতেও আসবে। তবে একেকটি রাতের আমেজ, আবেদন একেকটির চেয়ে আলাদা। আরব্য রজনীর ‘এক হাজার এক রাত্রি’র সেই গল্পগুলোর মতো। আলিবাবা চল্লিশ চোরের সঙ্গে যেমন আলাদিনের মিল নেই, কিয়ামত জিনের গল্পও আলাদা; কিন্তু আবেদনে কেউ কারও চেয়ে কম নয়। এই উত্তর-আধুনিক যুগে সেসব চরিত্র তামাদি হলেও লোকে রূপকথা ভালোবাসে। কর্মব্যস্ত দিন শেষে গভীর রাতে টিভিটা খুলে দেখতে চায় খেলার মাঠের রূপকথা, সুখ, আনন্দ আর ছোট ছোট সব দুঃখগাথা। পরশু রাত এবং গতকাল সকালের প্রথম প্রহর কি সেই প্রত্যাশা পূরণ করেনি? ফুটবল ভালোবাসলে বলতে পারেন, এই প্রশ্নই অবান্তর। তাহলে আর মিছেমিছি রাত জাগা কেন!
নির্ঘুম চোখে অপেক্ষা ছিল ৬টা বাজবে কখন! আটলান্টিকের ওপারে তখন থেকে যে শুরু হবে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের রাজপাট ফয়সালা হওয়ার লড়াই। নির্নিমেষ চোখে সেই লড়াইও দেখার পর জানালা খুলে নিশ্চয়ই সূর্যটা দেখেও ভালো লেগেছে। বার্লিনের অলিম্পিয়াস্তাদিওন থেকে রূপকথার জাল যে এবার ছড়িয়ে পড়বে মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামের পরতে পরতে!
শেষ বাঁশি বাজার পর হ্যারি কেইনকে খুব একটা দেখা গেল না। বেঞ্চে বসে থাকা অবস্থায় একবার ক্যামেরা ধরা হলো। আঁধার। দুর্ভাগ্য, না পাওয়ার যন্ত্রণা আর অপেক্ষার মিশেলে মানুষের মনে যে তিমির অমাবস্যা জমে, যা আলিফ লায়লায় আলাদিনের আশ্চর্য সেই প্রদীপ নিতে যাওয়ার পথের চেয়েও কালো—সেই ভাষাই অনূদিত হয়েছিল কেইনের মুখে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা ইউরো নামের সেই আশ্চর্য প্রদীপ তুলে নিয়ে আলাদিন হতে পারেননি। ‘অভিশপ্ত’ হয়েই থাকতে হলো আরও একবার। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে না ক্লাবের হয়ে, না দেশের হয়ে—কিছুই জেতা হলো না! নিয়তি তাঁর প্রতি কতটা নির্মম, শূন্যতায় ডোবার সেই লগ্নেই তাঁকে দেখতে হলো স্পেনের নতুন প্রজন্মের জয়গান। লামিনে ইয়ামাল, নিকো উইলিয়ামস, গাভি, পেদ্রিরা শিরোপা নিয়ে যখন উল্লাস করছিলেন, তখন কেইনের মুখটি নিয়তি যেন এক পাশে সরিয়ে দিল। এসেছেন নতুন ‘রাজা’, তাঁদের ছেড়ে দিতে হবে স্থান। কেইন রাজা ছিলেন না, শুধু টানা দুবার রাজপাট দখলের চেষ্টা করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তার সহ্য হয়নি! কারণটা তিনিই জানেন। মর্ত্যের মানুষ হিসেবে আমরা শুধু কল্পনাই করতে পারি।
সেই কল্পনায় সবার আগে উঠে আসেন ইয়ামাল। যে লিওনেল মেসির হাতে গোসল করে, আসলে অগ্নিস্নানে শুচি হয়ে ছেলেটি এতটা পথ উঠে এল, বিধিলিপি তাকে এড়িয়ে যায় কীভাবে! পরম্পরার সার্থক হাতবদলে ইয়ামালের হাতে শিরোপাটা তুলে দিতেই হতো। আগুনে আক্রমণে নবরূপে সাজা এই স্পেন টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি গোল করেছে, নতুন প্রজন্মও দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রস্তুত—ফাইনালে ইয়ামালের পাস থেকে নিকো উইলিয়ামসের গোলটি যেন সেই দায়িত্ব বুঝে নেওয়ারই ইঙ্গিত। বাকিটা তো আপনার জানাই—বিধিলিপি কখনো ভুল বিচার করে না।
এই স্পেন চ্যাম্পিয়ন না হলে যেমন ‘অন্যায়’ হতো, তেমনি এই স্পেন সর্বোচ্চ চারবার ইউরো জিতে রেকর্ড গড়েছে, ইয়ামাল তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন, কাস্তিয়ান নাইট ‘এল সিড’-এর মতো রদ্রি মাঝমাঠের অজেয় সিপাহসালারের ভূমিকায় হয়েছেন টুর্নামেন্টসেরাও—তবে এসবের বাইরেও অদৃশ্য যোগসূত্রে পরম্পরার সেই হাতবদলটা ঠিকই ঘটেছে।
বাংলাদেশ সময় গতকাল রাত ৩টা নাগাদ আপনি যখন ইয়ামালের হাতে ইউরোপসেরার শিরোপা দেখছেন, তখনো জানতেন না মায়ামিতে লিওনেল মেসির হাতে শিরোপা উঠবে কি না। সে কাণ্ডটিও ঘটে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকি ছিল না, বিধিলিপি ভুল বিচার করে না। বার্লিনে ১৭ বছর বয়সী স্প্যানিশ ‘উষা’ উদিত হওয়ার পর আটলান্টিকের ওপারে রেঙেছে অস্তরাগের ‘সূর্য’। কেউ কেউ সেই সূর্যকে ‘অবিনশ্বর ঈশ্বর’ও বলেন।
যেমন আর্জেন্টিনার সাইকেডেলিক রক ব্যান্ড এল প্লান দে লা মারিপোসা। কোপা আমেরিকার শুরুতে আনহেল দি মারিয়ার প্রতি নৈবেদ্য দিয়ে গান বেঁধেছিল ব্যান্ডটি। পঙ্ক্তিতে দি মারিয়াকে ‘দেবদূত’ ও মেসিকে ওই বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। গানের একটি লাইন এমন, দি মারিয়াকে ‘দেবদূত ভেবে বলেছে লোকে, অবিনশ্বর ঈশ্বরের খেয়াল রেখো।’
১৬ বছর ধরে এই ‘দেবদূত’ আর্জেন্টাইনদের অবিনশ্বর ঈশ্বরের খেয়াল রাখার পর কাঁদতে কাঁদতে ডানা গোটালেন। দি মারিয়ার কান্নার আগে বর্ষা নেমেছে আর্জেন্টাইন ফুটবল-ঈশ্বরের চোখেও। ৬৬ মিনিটে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার পর বেঞ্চে অঝোরে কেঁদেছেন মেসি। কে বলবে, এই মানুষটি ফুটবলে সবকিছু জিতেছে! কে বিশ্বাস করবে, এ মানুষটি তিন বছর ধরে আর্জেন্টাইনদের সবকিছু জেতানোর পরও একটি ম্যাচে স্রেফ চোটের কারণে বের হয়ে আসার দুঃখে শিশুর মতো কাঁদতে পারে!
দেবদূত পাশ থেকে সরে গিয়ে আসলে সম্মানই জানালেন মেসিকে। রাজার সভাসদ যখন ভেঙে যায় তখন কিন্তু মন্ত্রী-পরিষদবর্গই সরে দাঁড়ান সবার আগে। দি মারিয়া মেসির জন্য সে মঞ্চই প্রস্তুত করে গেলেন এক অনন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে—দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে টানা তিনটি বড় শিরোপা জয়। অথচ জার্সিটি খুলে রাখার আগে দেবদূতের কী বিনয়, ‘আমাদের এই প্রজন্মের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমি যা খুব করে চেয়েছিলাম, তারা আমাকে সেটা অর্জন করতে দিয়েছে।’
সাতসকালে কথাগুলো শোনার সময় কি আপনার চোখ ভিজে আসেনি? অনন্য এক রাত শেষে ভেজা ভেজা এসব অনুভূতিই তো প্রাপ্তি।